বাঙালি খুব গল্প শুনতে ভালোবাসে – তাই আসুন একটি গল্প শুনি, একেবারে পাতি মাছের ঝোল ও এক বিপ্লবীর গল্প শোনা যাক … 





আমরা অনেক বাঙালিই কিন্তু জানিনা যে আমাদের মত জাপানীরাও কিন্তু মাছভাত পেলে আর কিছু চায় না – আর তাই যদি কখনও জাপানে ভ্রমণ করতে যান, টোকিওর রাজপথে চলতে চলতে দুপাশে দেখবেন প্রচুর ভাতের হোটেল। প্রায় সব জায়গাতেই দেখতে পাবেন মাছের ঝোল ভাতের দোকান। জাপানীরা বলে ‘রাইসু কারি’ তবে স্বাদে তা বাঙালি মাছের ঝোলের ধারেকাছে আসেনা। ওদের এই কারিতে দেওয়া হয় মধু এছাড়াও থাকে বিভিন্ন রকমের ফল, এবং তাকে ঘন করার জন্য মেশানো হয় এরারুট, তাই বাঙালি জিভ এই রান্না নেবেন না মোটেই। এরই মাঝে চোখে পড়বে এক রেস্তোরার সাইনবোর্ডে লেখা #নাকামুরা “অথেন্টিক ইন্ডিয়ান কারী”, দোকানের নামটা দেখে চমকাবেন না যেন, ….. মনে পড়লো কিছু?
এবারে এই গল্পের সূত্রপাতে যাই।
১৯১৫ সনের ১২ ই মে কলকাতার খিদিরপুর বন্দর থেকে জাপানি জাহাজ ‘সানুকি-মারু’ সহযোগে তিনি ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ ভারতীয় বাঙালি বিপ্লবী। সেই বছরেই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জাপান যাত্রার প্রাক্কালে তিনি নিজেই কলকাতার পাসপোর্ট দফতর থেকে রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় রাজা প্রিয়নাথ ঠাকুর ছদ্মনামে পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন।
ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন কারণ, বড়লাট হার্ডিঞ্জের ওপর বোমা ফেলিয়েছিলেন যে, তাই ইংরেজরা ধরতে পারলেই ফাঁসিতে লটকে দিত। জাহাজে চেপে চলে গেলেন জাপানের কোবে শহরে, সময়টা জুন মাস। হাতে নামমাত্র টাকা, কোন বন্ধু, পরিজন পরিচিত মানুষ নেই জাপানে। একেবারে একা। সেখানেই পরিচয় এক তরুণ চিনা বিপ্লবীর সঙ্গে। তিনিই পরবর্তী কালের বিশ্ববরেণ্য বিপ্লবী ‘সান ইয়াৎ সেন।’
সাহায্য পেলেন জাপানের প্রখ্যাত এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও “প্যান এশিয়ান” আন্দোলনের সামুরাই নেতা মিৎসু তোয়ামা’র। সন্তানস্নেহে তিনি কাছে টেনে নিয়েছিলেন এই স্বাধীনতা সংগ্রামী ভারতীয় বিপ্লবীকে। ওনারই সাহায্যে কোবে থেকে চলে গেলেন টোকিওতে।
২৭ নভেম্বর টোকিয়োতে তিনি গোপনে লালা লাজপত রায়ের সঙ্গে সভা করলেন। কিন্তু পরিচয় পরিষ্কার করে না জানতে পারলেও, জাপানে আগত কোন এক অজ্ঞাত পরিচয় আগন্তুকের সম্পর্কে খবর গেল ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের কাছে। তার পরই ব্রিটিশ সরকার লিখিত ভাবে অনুরোধ জানালো জাপানী পুলিশকে এবং জাপান সরকার মারফৎ জারি হল নির্বাসনের আদেশ।
এদিকে বৃটিশ পুলিশ খবর পেয়ে তাকে পাকড়াও করতে তথা হত্যা করতে এতই মরিয়া ছিল যে পাশাপাশি নিয়োগ করলো পেশাদার খুনী। বাধ্য হয়ে ঐ বিপ্লবী কিছুদিন তোয়ামা সাহেবের বাড়িতেই লুকিয়ে থাকলেন। কিন্ত কাঁহাতক আর এক রাজনৈতিক নেতার বাড়িতে লুকিয়ে থাকা যায়, সারাদিন ধরে তার বাড়িতে নানান লোকজন আসছে, অতএব পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়ার যথেষ্ট ঝুঁকি। শেষে সেই তোয়ামা সাহেবেই সেই বিপ্লবীর আত্মগোপনের ব্যাবস্থা করে দিলেন টোকিওর সোমা নামে এক প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসায়ীর বাড়িতে। তবে ঠিক বাড়িতে বললে ভুল হবে, ঠাঁই হল ওনার পাঁউরুটি বিস্কুট তৈরির কারখানার ভূগর্ভস্থ অন্ধকার কুঠুরি ঘরে। অল্প দিনের মধ্যেই এই স্বাধীনতা সংগ্রামী ভারতীয় বিপ্লবী হয়ে উঠলেন তাঁদের ঘরের ছেলে। আইজো সোমা আর কোকো সোমাকে বাবা আর মা বলেই ডাকতেন তিনি।
এর মধ্যেই একদিন বৃটিশ রণতরী কামান দেগে ডুবিয়ে দিল জাপানের এক বাণিজ্য তরী। ব্যাস জাপানের সাথে ইংল্যান্ডের কূটনৈতিক সম্পর্ক শেষ, সাথে বন্দী প্রত্যার্পণ চুক্তিও খতম!
সময়টা ছিল ১৯১৮ সন, তোয়ামা সাহেবের উদ্যোগে সোমা পরিবারের বড়মেয়ে তোশিকোর সাথে মালাবদল হয়ে গেল ওই বিপ্লবীটির। এই বিয়ের পাঁচ বছর পরেই উনি পেয়ে যান জাপানী নাগরিকত্ব। কিন্ত দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়লো না, দুটি সন্তানের জন্ম দেবার পর ১৯২৭ সনে নিউমোনিয়ায় মারা গেলেন স্ত্রী “তোশিকো”, যিনি এক পলাতক বিপ্লবীকে প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে, স্বেচ্ছায় বিয়ে করে বেছে নিয়েছিলেন অনিশ্চিত এবং পলাতকের জীবন …. আমাদের সভ্য বুদ্ধিজীবী বাঙালির ইতিহাস কিন্তু তাকে মনে রাখেনি। 



বিয়ে করে সংসার ধর্ম পালন করলেও বিপ্লবী মানুষটি কিন্ত তার মূল লক্ষ্য থেকে সরে আসেন নি। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য জাপানের মাটিতে বসেই ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে গেছেন, তৈরি করেছেন ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেনডেন্স লীগ, এবং তার অনুসঙ্গ হিসাবে ভারতের বাইরে সিঙ্গাপুরে তৈরি করেছেন ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (যা কিনা আজাদ হিন্দ ফৌজ নামেও পরিচিত)। প্রথমে আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বে ছিলেন কমান্ডার মহন সিং – কিন্তু ক্রমশ আজাদ হিন্দ ফৌজ বিগঠিত হয়ে যায়, এবং পরে এই বিপ্লবী মানুষটিই আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্ব তুলে দেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর হাতে। তিনিই প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম যিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে এই ফৌজের কম্যান্ডার করার ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। তাঁরই আদর্শের অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু।
নিজে উনি জাপানে থাকলেও ক্রমাগত চিঠিপত্র ও বক্তৃতার মাধ্যমে ভারতবর্ষকে ইংরেজের অত্যাচার থেকে মুক্ত করার জন্য বিশ্বজুড়ে জানিয়েছেন সাহায্যের আবেদন।
১৯২৩ সালে জাপানি নাগরিক হন তিনি, সেখানে বাস করতে থাকেন সাংবাদিক তথা লেখক হিসেবে। সেই সময়ে এই বিপ্লবী #নাকামুরায়ার বোস নামে পরিচিত ছিলেন।
এরই মাঝে একদিন খেতে বসে আবিষ্কার করলেন জাপানি মাছের ঝোলে ইউরোপিয়ান মশলাহীন রান্নার প্রভাব খুব বেশি। রান্নাবান্নায় ওনার যথেষ্ট উৎসাহতো ছিলোই, তাই কালবিলম্ব না করে রেঁধে ফেললেন বিশুদ্ধ বাঙালি মাছের ঝোল। খেয়ে তো জাপানে ওনার শশুড়বাড়ির আত্মীয় পরিজন, এবং প্রতিবেশী ও বন্ধুরা একদম মোহিত। মূলত তাদেরই চেষ্টায় ১৯২৮ সনে ঐ বেকারির ছাদে খোলা হলো রুফটপ রেস্তোরা, নাম #নাকামুরা_কাফে। ভারতীয় বিপ্লবীর তত্তাবধানে সেখানে রান্না হতে লাগলো বাঙালি মাছের ঝোল ছাড়াও ভারতের অন্যান্য প্রদেশের মাছ মাংসের হরেক পদ, মূলত ভারতীয় মশলা দিয়ে কষিয়ে রান্না করা ঝোল প্রধান পদ, যা ভাত দিয়ে খাওয়া যায়। টোকিওর আম জনতাকে এই বাঙালি মাছের ঝোল খাইয়েই উনি পরিচয় করাতে চাইলেন সনাতন ভারতবর্ষের সঙ্গে।
তাঁকে মাথায় রেখেই বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক শ্রী শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন পথের দাবী উপন্যাসটি। সব্যসাচী ওই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র, যে চরিত্রে পরে বাংলার মহানায়ক উত্তম কুমার অভিনয় করেছিলেন।
পাঠক এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন কে এই বিপ্লবী? –
টোকিওতে এসে এই নাকামুরা বেকারীতেই আশ্রয় পান *মহান বিপ্লবী শ্রী রাসবিহারী বসু।* অচিরেই এই ভারতীয়, বাঙালি মাছের ঝোল জাপানে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।
১৯৪৫ সনে শ্রী রাসবিহারী মারা যাবার পর এই রেস্তোরা টোকিওর জনবহুল এবং অত্যন্ত ব্যস্ত অফিসপাড়া শিনঝাকু এলাকাতে সরিয়ে আনা হয়। আজও সেখানে তাঁর দেওয়া রন্ধন প্রণালী মেনেই ভারতীয় বাঙালি মাছের ঝোল রান্না করা হয়, এই রেস্তোরায় প্রবেশ পথের মুখেই শোভা পায় ধুতি ও কালো কোট পরিহিত মহান এই বঙ্গসন্তানের সস্ত্রীক বিশাল প্রতিকৃতি।
আশেপাশের অন্যান্য সমস্ত রেস্তোরা থেকে বহুগুন দাম বেশি হওয়া সত্ত্বেও দ্বিপ্রাহরিক মধ্যাহ্ন ভোজনের সময় এখানে পাত্ পেতে খাওয়ার জন্য খালি আসন পাওয়া মুশকিল। ২০০১ সন থেকে সেই একই রন্ধন প্রণালী মেনে তৈরী হওয়া তাত্ক্ষণিক তৈরী মাছের ঝোলের বিপণন হচ্ছে সারা জাপান জুড়ে। বর্তমানে সারা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা আশিটি শাখা যুক্ত নাকামুরা ফুড কোম্পানির ২০১৬ সালে বাণিজ্যিক মূলধন ছিল ২৬০০,০০০,০০০ ইয়েন (২৬০ কোটি/২.৬ বিলিয়ন)!
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে গদর বিদ্রোহের অন্যতম মস্তিষ্ক রাসবিহারী বসুর জীবন ছিল অত্যন্ত বর্ণময় এবং দুঃসাহসিক। বিপ্লবী শ্রী রাসবিহারী বসু ছিলেন অকুতোভয় কিন্তু তিনি ও তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজ আমাদের স্মৃতিতে আজ ধূসর, পরবর্তী প্রজন্মে আদৌ এই সম্পর্কে আর কোন ধারণা থাকবে কি না জানা নেই। কিন্ত বাঙালি মাছের ঝোলের মধ্যে দিয়ে #নাকামুরার কয়েক লক্ষ জাপানির মানসপটে আজও সেই মহান বিপ্লবীর উজ্জ্বল উপস্থিতি সতেজ রয়েছে।
*এই মহান হিন্দু বঙ্গসন্তানটির আজ আবির্ভাব দিবসে, ওনাকে জানাই আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণাম* …. 





উনি পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার সুবলদহ গ্রামে জন্মেছিলেন ২৫ শে মে, ১৮৮৫।
পিতার নাম শ্রী বিনোদবিহারী বসু এবং মা শ্রীমতি ভুবনেশ্বরী দেবী। তিনকড়ি দাসী ছিলেন তাঁর ধাত্রী মাতা। এই বসু পরিবারের আদিবাস ছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার বৈঁচীতে। পরবর্তীকালে এই পরিবার বৈঁচী থেকে প্রথমে সেই জেলারই সিঙ্গুরে এবং পরবর্তীকালে পূর্ব বর্ধমান জেলার সুবলদহে চলে আসেন। তাঁদের পূর্বপুরুষ নিধিরাম বসুই সর্বপ্রথম সুবলদহে বসবাস শুরু করেছিলেন।
একটি মতানুযায়ী, তিনি অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার ভদ্রেশ্বরের সন্নিকটস্থ পাড়েলা-বিঘাটি গ্রামে তার মাতামহ নবীন চন্দ্র সিংহের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। অন্য মতানুসারে তিনি সুবলদহ গ্রামের পশ্চিম পাড়াতে অবস্থিত বিষ্ণুমন্দির বা কৃষ্ণ মন্দিরে তাঁর জন্ম হয়। গর্ভাবতী অবস্থায় তাঁর মা ভুবনেশ্বরী দেবী কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাই সুবলদহ গ্রামের পশ্চিম পাড়াতে অবস্থিত ওই বিষ্ণু মন্দিরে বা কৃষ্ণ মন্দিরে ভুবনেশ্বরী দেবীর নামে মানত করা হয়েছিল যাতে তিনি সুস্থভাবে সন্তানের জন্ম দেন, তাই পরবর্তীকালে রাসবিহারী বসুর দাদু শ্রী কালিচরণ বসু নাতির নাম রাখেন, রাসবিহারী। শ্রী কৃষ্ণের অপর নাম অনুসারে। রাসবিহারী বসুর শৈশবের পড়াশোনা সুবলদহের গ্রাম্য পাঠশালায়। বর্তমানে এই স্কুলের নাম তাঁর নাম রাখা হয়েছে – সুবলদহ রাসবিহারী বসু প্রাথমিক বিদ্যালয়। তার দাদু শ্রী কালিচরণ বসু এবং তার শিক্ষকদের থেকে বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী ঘটনা তথা ভারতীয়দের প্রতি ইংরেজের অত্যাচারের ইতিবৃত্ত শুনে শুনেই তিনি তাঁর বিপ্লবী আন্দোলনের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন।…
তিনি ডাংগুলি খেলতে খুব ভালোবাসতেন এবং তিনি তরুণ বয়সেই ইংরেজদের মূর্তি তৈরি করে লাঠি খেলার কৌশলে সেই মূর্তিগুলোকেই ভেঙে ফেলতেন। তিনি ছোটবেলায় ১২ থেকে ১৪ বছর অবধি সুবলদহ গ্রামে বসবাস করেছিলেন। তবে পরবর্তীকালে তিনি ব্রিটিশ পুলিশের চোখে ধূলো দিয়ে সুবলদহ গ্রামে এসে গা ঢাকা দিয়ে থাকতেন।
পিতা বিনোদবিহারী বসুর কর্মক্ষেত্র ছিল হিমাচল প্রদেশের অত্যন্ত জনপ্রিয় স্থান শিমলা। তবে রাসবিহারী বসু সুবলদহ পাঠশালা, মর্টন স্কুল ও ডুপ্লে কলেজের ছাত্র ছিলেন।
জীবনের প্রথম দিকে তিনি নানা বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং তাঁর কর্মকাণ্ড নাড়িয়ে দিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত। ভারতবর্ষের সশস্ত্র বিপ্লবের ইতিহাসে তাঁর নিদারুন অবদানের দিকে একবার ফিরে তাকানো যাক।
ব্রিটিশ শাসকদের পক্ষে হিমালয়ে ঘেরা দেরাদুন উপত্যকা সর্বদাই নিরাপদ আশ্রয় হয়ে থেকেছে। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের সময়ে দিল্লির ও মিরাটের অতি সংলগ্ন দেরাদুন ও নিকটবর্তী আরেক পার্বত্য শহর মুসৌরি রাজনৈতিক ভাবে ঠান্ডাই থেকেছে। তাই বহু ব্রিটিশ পরিবার পাশের জেলাগুলো, যেখানে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে অশান্তি হচ্ছিল, সেখান থেকে স্থানান্তরিত হয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিল ওই পার্বত্য অঞ্চলে। এই শান্তির পার্বত্য আবহে উদ্বুদ্ধ হয়েই ব্রিটিশরা দুন উপত্যকাকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শহর বানিয়ে তুলেছিল যাতে তাদের নিজেদের ছেলেমেয়েরা থাকে দুধে ভাতে। তাই সার্ভে অফ ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়ান মিলিটারি অ্যাকাডেমি, বর্তমান আর.আই.এম.সি এবং নাভাল হাইড্রোগ্রাফিক অফিসও তৈরি হয়েছিল সেখানেই। এই প্রতিষ্ঠানগুলি নিয়ে ভারতবর্ষের শিক্ষিত হিন্দু তরুণদের মধ্যেও আগ্রহ বাড়ছিল, কারণ এই শিক্ষিত যুবকদের একাংশ চাইছিল পশ্চিমের ভাবধারায় শিক্ষিত হতে যাতে ইংরেজদের দয়া দাক্ষিণ্যে তাদের অধস্তন হিসাবে চাকুরীজীবি হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনের মুখে আগুন জ্বেলে দিয়ে আরামের জীবন যাপন করা যায়।
*কিন্তু রাসবিহারী বসুর মস্তিষ্কে মাথাচাড়া দিচ্ছিল শৃঙ্খলিত ভারতকে মুক্ত করার স্বপ্ন।*
আলিপুর বোমা বিস্ফোরণ মামলায় ১৯০৮ সালে অভিযুক্ত হন। এরপর কলকাতা ছেড়ে তিনি চলে যান দেরাদুনে। সেখানে বন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ করণিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পল্টন বাজারের কাচে ঘোসি গলিতে থাকতেন তিনি। ঘিঞ্জি ঘোসি গলির এরকম নাম হওয়ার কারণ সম্ভবত বেশ কিছু বাঙালির এখানে বসবাস।
দেরাদুনে বসবাস কালীন তিনি গোপনে বাংলা (অবিভক্ত), উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবের বিপ্লবীদের সংস্পর্শে আসেন। এই সময়েই ওনার সঙ্গে যোগাযোগ হয় যুগান্ত সংগঠনের অমরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। তাঁরই হাত ধরে বাঘা যতীনের নেতৃত্বাধীন এক বিপ্লবী গোষ্ঠীর কাজকর্মে জড়িয়ে পড়েন রাসবিহারী। যোগাযোগ হল আর্য সমাজের বিপ্লবী সদস্যদের সঙ্গে, যাঁদের কাজের জায়গা ছিল বর্তমান উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাব। এমনই দুঃসাহসিক ছিলেন উনি, যে নিজে ইংরেজ প্রতিষ্ঠানে কাজ করা সত্ত্বেও তাঁর মাথায় ঘুরে বেড়াত ইংরেজদের দেশ থেকে তাড়ানোর বৈপ্লবিক চিন্তা ভাবনা।
তার অন্যতম কৃতিত্ব, তিনি দিল্লিতে বড়লাট হার্ডিঞ্জের ওপর প্রাণঘাতী বোমা হামলায় নেতৃত্ব দেন। ১৯১২ সালের ২৩ ডিসেম্বর। কলকাতা থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত হচ্ছে দিল্লিতে। দিল্লি প্রস্তুত তৎকালীন ভাইসরয় সর্ড হার্ডিঞ্জকে স্বাগত জানানোর জন্য। চাঁদনি চকের এক বাড়িতে এক রোগা চেহারার মহিলাকে দেখা গেল ভাইসরয়কে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছেন। বোমা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। আসলে ১৬ বছররের এক কিশোর বিপ্লবী ‘বসন্ত বিশ্বাস’ মহিলার ছদ্মবেশে, রাসবিহারী বসুর নির্দেশে দিল্লীতে হার্ডিঞ্জকে লক্ষ্য করে দেশি বোমা ছোঁড়েন হাতিতে বসা ভাইসরয়ের দিকে। ভারতীয় বিপ্লবীদের পেশাদারি গেরিলা আক্রমণ শৈলীর পটুতার অভাবে – আমাদের দুর্ভাগ্য যে হার্ডিঞ্জ বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু ভয়ানক জখম এড়াতে পারেনি। এই হামলার সম্পূর্ণ পরিকল্পনা ছিল রাসবিহারী বসুর। এমনকি সেই বোমা তৈরিতে সাহায্যও করেছিলেন তিনিই। বিস্ফোরণের দিন রাত্রেই তিনি দিল্লি ছাড়েন এবং পরদিনই দেরাদুনে ফিরে আসেন রাসবিহারী এবং নিজের কাজের জায়গায় স্বাভাবিক ভাবেই পুনরায় কাজকর্ম করতে থাকেন। এমনকি কয়েক মাস পর হার্ডিঞ্জকে স্বাগত জানিয়ে এক অনুষ্ঠানের আয়োজনও করেন তিনি।
কিন্তু রাসবিহারী বসুর দিকে আঙুল উঠতে শুরু করে এবং সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী হিসেবে তাঁর ভূমিকা নিয়েও গুঞ্জন শুরু হয় এবং সেই বোমা হামলায় নেতৃত্ব দানের কারণে পুলিশ তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করে। উত্তর ভারতে প্রায় তিন বছর ধরে চলে বিড়াল-ইঁদুর খেলা। যখন ইংরেজ সরকার তাঁর মাথার দাম ধার্য করেছে এক লক্ষ টাকা, সে সময়ে পুলিশের চিফ কমিশনারের ঠিক উল্টো দিকে বসে ছদ্মবেশে ট্রেনে সফর করেছিলেন তিনি। কারণ তাঁর মনে হয়েছিল যে সেইটাই সবথেকে সুরক্ষিত জায়গা। তবে পুলিশ তাঁকে কখনই গ্রেপ্তার করতে পারেনি। বহু বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকায় সরকারের সন্দেহ তীব্রতর হয়। তিনি ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার নজর এড়াতে সক্ষম হন এবং ১৯১৫ সালে জাপানে চলে যান।
জাপানে বিভিন্ন এশিয় গ্রুপের ছত্রছায়া খুঁজে পেলেন রাসবিহারী। ১৯১৫ -১৯১৮ সালের মধ্যে তিনি বহুবার নিজের পরিচয় বদলান, বদলান বাসস্থানও। ব্রিটিশরা রাসবিহারীর প্রত্যর্পণের ব্যাপারে জাপ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করছিল।
সেই সময়েই টোকিওর #নাকামুরা বেকারির মালিকের বাড়িতে লুকিয়ে থাকার সময়ে তাঁরই একমাত্র মেয়ে তোশিকো সোমাকে বিয়ে করেন তিনি। বাঙালিদের বিভিন্ন রান্না, শাড়ি পরা, জাপানি বউকে সব শিখিয়েছিলেন রাসবিহারী বসু। তাঁদের বিবাহের পূর্বে দেড় মাসে ‘সোমা বাড়ির’ পরিবেশ আমূল বদলে গিয়েছিল। চারদিকে একটা চাপা আতঙ্ক! তোশিকো সোমার মা-বাবা তো বটেই, দোকানের প্রতিটি কর্মচারীও প্রতি মুহূর্তে সন্ত্রস্ত। সব কিছুর কারণ ভারতীয় বিপ্লবী রাসবিহারী বসু। দেড় মাসেরও বেশি সময় যিনি আত্মগোপন করেছিলেন বাড়ির পেছনে এবং রুটি কারখানার ভূগর্ভস্থ পরিত্যক্ত গুদামঘরে। সাদা পোশাকের জাপানি গোয়েন্দারা সর্বক্ষণ ওত পেতে ছিল আশেপাশে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুকে দরবার জন্য। ধরা পড়লেই পরিবারের এত দিনের সম্মান, তিল-তিল করে গড়ে তোলা ব্যবসা ধুলোয় মিশতে সময় নিত না। জাপান থেকে কত দূরের দেশ ভারতবর্ষ! সেখানকার এক তরুণ বাঙালি বিপ্লবীর সঙ্গে সিঞ্জিকু শহরের সম্ভ্রান্ত সোমা পরিবারের ভাগ্য যে এ ভাবে জড়িয়ে যাবে, কল্পনাও করেননি পরিবারের বড় মেয়ে, সদ্য কুড়ি পদার্পন করা তোশিকো। তাঁর বাবা-মা আইজো সোমা আর কোকো সোমা বিখ্যাত ‘#নাকামুরা’ বিপননির মালিক। জাপানের জনপ্রিয় বেকারি #নাকামুরার কেক, বিস্কুট, রুটি কিনতে ভিড় করেন টোকিয়োর সমস্ত ‘অভিজাত’ সম্প্রদায়ের মানুষ। এ হেন পরিবারের সঙ্গে ভারতবর্ষের কোনও বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীর কোনরকম সম্পর্ক থাকার কথাই নয়। কিন্তু আশ্চর্য সব ঘটনা তো এই পৃথিবীতেই ঘটে। আর সদ্য কৈশোর পেরোনো তোশিকো সোমা? বার কয়েক মাত্র সেই অকুতোভয় বাঙালি বিপ্লবীকে দূর থেকে দেখেছেন তিনি। নাম শুনেছেন – রাসবিহারী বসু। অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান, লম্বা চওড়া সুঠাম যুবা। চওড়া কাঁধ, দৃঢ় চোয়াল। দৃপ্ত গভীর দুই চোখ। মানুষটাকে দেখলেই বুক কেমন যেন শিরশির করেছে তোশিকোর, যদিও অত্যন্ত মার্জিত ভদ্র রাসবিহারী দূরে তোশিকোর উপস্থিতি বুঝতে পেরেও কোনদিন চোখ তুলে তাকাননি।
জাপানিরাও প্রচন্ড দেশভক্ত, স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ। আবার জাপানে আত্মহত্যার প্রবণতা অত্যন্ত বেশি। এবং দেশের জন্য হাসতে হাসতে নিজেদের প্রাণ বলি দেওয়া তাঁদের কাছে জলভাত। পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করার তাগিদ তাঁদেরও যুগ যুগ ধরে মজ্জাগত।
তাই যখন তোশিকো জানতে পারলেন যে রাসবিহারী নামক যুবকটি ছদ্মবেশে তিন মাস জাহাজে ভেসে, নিজের জীবন বিপন্ন করে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে অচেনা দেশে চলে এসেছেন স্রেফ নিজের দেশের স্বাধীনতার লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন বলে এবং নিষ্ঠুর বর্বর ব্রিটিশ শাসককে ঘোল খাইয়ে ছাড়ছেন, তোশিকো তখন মনে মনে শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছেন মানুষটিকে। আর ভাললাগা? অত্যন্ত শিক্ষিতা, সম্ভ্রান্ত বংশীয় অন্তর্মুখী জাপানি তরুণী নিজের অন্তর থেকে তেমন কোনও ভাবনাকে প্রশ্রয় দিতে চাননি কখনও। তবু মন উচাটন। হঠাৎ হঠাৎ যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে তাঁর চিন্তামগ্ন মুখ।
তাঁর শ্বাশুড়ি কোকো সোমা নিজের বইয়ে লিখেছেন — ‘মাস চারেক পর রাসবিহারীর উপর থেকে নির্বাসনদণ্ড উঠে গেল। ১৯১৬-র এপ্রিলের এক সকালে আমার ঘরে উনি বিদায় জানাতে এলেন। তখন আমি শয্যাশায়ী। শরীর ও মনে বিদ্ধস্ত। রাসবিহারীকে লুকিয়ে রাখতে গিয়ে যে প্রবল মানসিক চাপ সহ্য করতে হয়েছিল আমাদের সারা পরিবারকে তাতে আমার স্তনের দুধ শুকিয়ে গিয়েছিল। দুধ না-পেয়ে মারা গিয়েছিল আমার সদ্যোজাত কন্যা। তবুও ওই ভারতীয় যুবার প্রতি বিন্দুমাত্র বিতৃষ্ণা আসেনি। কারণ সে দেশমাতৃকার প্রতি বলিপ্রদত্ত। উল্টে জানালা দিয়ে তাঁর চলে যাওয়া দেখে কান্না সামলাতে পারিনি। সে দিনই পণ করি, ভারতের আত্মার সঙ্গে যুক্ত হলাম আমরা এবং ভারতের এই বিপ্লবীকে সর্বশক্তি দিয়ে রক্ষা করব, যেভাবেই হোক।’
#নাকামুরা থেকে বেরিয়ে আজাবু অঞ্চলে বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন রাসবিহারী। যাঁরা তাঁর প্রাণ বাঁচিয়েছেন, সেই সোমা পরিবারের সবাইকে এক দিন নিজের বাড়িতে নৈশভোজে ডাকলেন। নিজের হাতে ভারতীয় বাঙালি প্রথায় মাছের ঝোল রান্না ভাত করেছিলেন, আর সবাইকে অবাক করে একটা ধন্যবাদসূচক বক্তৃতা দিয়েছিলেন জাপানি ভাষাতে। সেই একান্ত পারিবারিক সভাতেই তোশিকো ও রাসবিহারীর প্রথম মুখোমুখি পরিচয়, যদিও কোন কথা হয়নি তেমন।
এর পর বছর তিনেক জাপানের বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়ালেন রাসবিহারী। গোয়েন্দারা লেগে রয়েছে, আস্তানা পাল্টাতে হচ্ছে বারবার। নাকামুরায়ার উপরেও সন্দেহ গাঢ় হয়েছে পুলিশের। সোমা পরিবারের লোকেরা দেখা করতে যেতে পারেন না তাঁর সঙ্গে। যেখানেই বাড়ি নিচ্ছেন, অবিবাহিত, বিদেশি যুবককে পাড়ার লোক সন্দেহের চোখে দেখছে। তাতে গোয়েন্দাদের কাছে খবর যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। পুরো বিষয়টি অত্যন্ত চিন্তায় ফেলল চরম অতিথিপরায়ণ সামুরাই নেতা মিৎসু তোয়ামাকে। অনেক ভেবে তিনিই একটি সমাধান বার করলেন এবং অনেক ইতস্তত করে তা বলেই ফেললেন সোমা দম্পতিকে। তাঁদের বড় মেয়ে তোশিকোর সঙ্গে তিনি বিয়ে দিতে চান রাসবিহারীর। তাতে লোকের সন্দেহ কমবে, পুলিশের নজর এড়ানো যাবে, আর জাপানি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে রাসবিহারীর জাপানের নাগরিকত্ব পাওয়াও সহজ হয়ে যাবে।
প্রস্তাব শুনে স্তব্ধ হয়েছিলেন আইজো সোমা আর কোকো সোমা। তোশিকো তাঁদের বড়ই আদরের মেয়ে, শিক্ষা, স্বভাব, রূপ — কোনও দিকেই কমতি নেই। জাপানের সেরা সেরা পাত্রদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে যায় তাঁকে বিয়ে করার জন্য। আর তাঁকে কি না তুলে দেবেন পুলিশের তাড়া খেয়ে বেড়ানো, এক কপর্দকশূন্য বিদেশি বিপ্লবীর হাতে! যাঁর কিনা, যে কোনও মুহূর্তে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হতে পারে! বেঁচে থাকলেও পালিয়ে, লুকিয়ে বেড়াতে হবে, কতদিন কে জানে! আবার রক্ষণশীল জাপানি সমাজে ভিন জাতি বা ধর্মে বিয়েতে একঘরে হওয়ারও আশঙ্কাও বিদ্যমান। কিন্তু তোয়ামার মতন বিখ্যাত প্রভাবশালী জননেতার প্রস্তাব ফেরানোও তাঁদের পক্ষে প্রায় অসাধ্য। আর রাসবিহারীও তাঁদের বড় কাছের মানুষ, যাকে তাঁরাও খুবই স্নেহ করেন, এবং তাঁর অত্যন্ত অমায়িক স্বভাবের জন্য ভালোবেসে ফেলেছেন। কী এক অদৃশ্য মায়ায় তাঁদের বেঁধে ফেলেছে এই ভারতীয় ছেলেটি এবং তাঁর প্রাণ বাঁচানোর উপায় একটাই — তোশিকো সোমা।
এক দিন তোশিকোকে কথাটা বলেই ফেললেন কোকো। প্রতিবাদ, কান্নাকাটি আশা করেছিলেন। কিন্তু তাঁকে অবাক করে শান্ত তোশিকো মাকে বললেন, ‘‘আমাকে মনস্থির করার জন্য একটু সময় দাও।’’ বিষয়ের গভীরতা বুঝতে ভুল হচ্ছে না তো মেয়েটার? মা তাঁকে এই বিয়ের যাবতীয় সমস্যা বোঝালেন। মেয়ের একই উত্তর, ‘‘আমি ভেবে জানাচ্ছি।’’
তিন সপ্তাহ পরে তোশিকো মাকে বলেছিলেন, ‘‘আমি মিস্টার বোসকে বিয়ে করতে চাই। তাঁকে রক্ষা করতে চাই। তার মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার সংকল্পে তাঁর পাশে থাকতে চাই। এই সিদ্ধান্ত বদলাবে না।’’
সোমা দম্পতি এ বার রাসবিহারীর কাছে তাঁর মত চান। উত্তর এল, ‘‘বিপ্লব এবং ভারতবর্ষকে স্বাধীন করাই আমার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। বিয়ের কথা কখনও ভাবিনি, ভাবার সময়ও নেই। আমার যা জীবন তাতে এ সব ভাবার কথাও না, ভাবা বিলাসিতা। তবে আমার প্রথম আশ্রয়দাতা মিস্টার মিৎসু তোয়ামার যদি এটাই আদেশ হয় এবং মিস তোশিকো নিজেও যদি রাজি থাকেন তা হলে আমি বিয়ে করতে পারি।’’
১৯১৮-র ৯ জুলাই তোশিকো-রাসবিহারীর গোপন বিয়ের সাক্ষী থাকলেন সোমা পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ মাত্র গুটিকয় মানুষ। জাঁকজমকে যে বিয়ের সারা #নাকামুরা অঞ্চলে সাড়া ফেলে দেওয়ার কথা, সেখানে বর পক্ষের কোনও আত্মীয়-বন্ধু পর্যন্ত উপস্থিত ছিলেন না। উপরন্ত কোকো সোমা তখনও শয্যাশায়ী। দোতলার জানলা দিয়ে তিনি দেখলেন, অতি সাধারণ পোশাকে একদম অনাড়ম্বর ভাবে তাঁর মেয়ে চলেছেন বাবার হাত ধরে ট্রেনে চড়ে চলেছে টোকিয়োতে, যে কিনা গাড়ি ছাড়া কখনও বাড়ির বাইরে বের হননি। ট্রেনে চড়ে বাবা-মেয়ে গেলেন মিৎসু তোয়ামার বাড়ি। সেখানেই তোশিকোর বিয়ের পোশাক কিনে রেখেছিলেন মিৎসু তোয়ামার স্ত্রী। তিনিই সাজালেন কনেকে। অনুষ্ঠানে পিতার ভূমিকায় রইলেন মিৎসু তোয়ামা স্বয়ং। তোশিকো সোমা হয়ে উঠলেন তোশিকো বসু। পরবর্তী কালে জাপানে তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন ‘দ্য লিভিং ফ্লেশ শিল্ড টু দি ইন্ডিয়ান ইন এগজ়াইল’ নামে।
বিয়ের পর ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের ভয়ে সমানে বাড়ি বদল। কোথাও দু’মাস, কোথাও তিন। এমন বাড়ি বাছা হত যেগুলো হয় জঙ্গলের মধ্যে, নয়তো সমুদ্রের পাড়ে বা কাদাজমির ধারে। অধিকাংশ বাড়িতে ভাল করে সূর্যের আলো ঢুকত না। দিনের বেলাতেও অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে হয়ে থাকত ঘর।
তোশিকোর জন্য ভিতরে-ভিতরে অনুতাপে দগ্ধ হয়েছিলেন রাসবিহারী। তাঁর জীবনের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছেন বলেই না এমন ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন চরম বৈভবের মধ্যে মানুষ হওয়া তোশিকো। আর এই জীবনের সঙ্গে তাল মেলানোটাও হয়তো চাপে পড়ে, বড়দের কথা রাখতে। রাসবিহারী স্বামীর কর্তব্য অনুযায়ী তোশিকোকে ভালবেসেছেন মন প্রাণ দিয়ে, কিন্তু তিনি তোশিকোর মনের তল পাননি তখনও। তোশিকো সংসারের সব দায়িত্ব নিখুঁত ভাবে পালন করতেন মুখ বুজে, কিন্তু আবেগের বহিঃপ্রকাশেও অতি সংযমী জাপানি নববধূটি।
তখন তাঁরা চিবায় সমুদ্রের ধারের একটি বাড়িতে। এক দিন প্রশ্নটা করেই ফেললেন মানসিক ভাবে বিদ্ধস্ত রাসবিহারী, ‘‘তুমি যে আমাকে বিয়ে করেছ, কিন্তু আমায় ভালোবাসতে পেরেছো কি? আমি সত্যিটা জানতে চাই, না হলে আমি তোমাকে আটকাতে চাই না।’’
প্রশ্নের আকস্মিকতায় নিষ্পল ভাবে খানিক্ষন স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকেন তোশিকো। চোখের জল এসে তাঁর দুই গাল ভিজিয়ে দেয়। অস্থির রাসবিহারী তখন বেপরোয়া, উত্তেজিত। বলছেন, ‘‘বলো, তুমি কি আমার জন্য কি জীবন দিতে পারো?’’ কথা শেষ না হতেই তিরবেগে খোলা জানালার দিকে ছুটলেন তোশিকো। ঝাঁপ দিতে যাবেন সমুদ্রে, পিছন থেকে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন রাসবিহারী।
এ এক আশ্চর্য প্রেমকাহিনি এবং বিবাহিত জীবন। অঙ্কের সরল হিসেবে মাত্র আটটি বছর তার মেয়াদ, কিন্তু তোশিকোর অকালমৃত্যুর পর বাদবাকি জীবন সেই ভালবাসার মধ্যেই থেকেছেন রাসবিহারী বসু। এমনকি তোশিকোর মা কোকো তাঁকে আবার বিয়ে করার জন্য বারংবার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। রাসবিহারী হেসে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘তোশিকো ছাড়া আর কাউকে ভালবাসা আমার পক্ষে এ জীবনে অসম্ভব। আমাদের আট বছরের নির্জন জীবনের মতো তোশিকো চিরকাল আমার কাছেই থাকবে। আমার মনের গভীরে। আমার আর কিচ্ছু চাই না।’’
ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের তাড়ায়, আট বছরের দাম্পত্য জীবনে সতেরো বার বাড়ি বদলাতে হয়েছিল রাসবিহারী-তোশিকোকে। ধরা পড়ার ভয়, সঙ্গে তীব্র অর্থসঙ্কট। কিন্তু কিছুই চিড় ধরাতে পারেনি তাঁদের দাম্পত্যে। রাসবিহারীর জীবনের যাবতীয় ঝড়ঝাপটায় তোশিকোই ছিলেন তাঁর একমাত্র রক্ষাকবচ। তিনি সংসারের হাল ধরেছিলেন বলেই ভারতের স্বাধীনতার কাজে নিজেকে সঁপে দিতে পেরেছিলেন বীর বিপ্লবী। এক জায়গায় তাই তিনি লিখেছিলেন — ‘আওয়ার ম্যারেড লাইফ ওয়াজ ভেরি শর্ট বাট ইট ওয়াজ আ ব্লিস। আই হ্যাড আ ফিলিং দ্যাট আই এনজয়েড টোটাল হ্যাপিনেস ডিউরিং দোজ ফিউ ইয়ার্স।’ প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুর অনেক বছর পর রাসবিহারীর মৃত্যু হলে টোকিয়োর তামা শ্মশানে তোশিকোর সমাধির উপরেই তৈরি হয়েছিল তাঁর সমাধি।
রাসবিহারী বসু যত্ন করে তোশিকোকে বাংলা শিখিয়েছিলেন। বন্ধু শচীন্দ্রনাথ সান্যালকে ১৯২২-এর জুলাইয়ে টোকিয়ো থেকে পাঠানো চিঠিতে লিখেওছিলেন সে কথা। শুধু তা-ই নয়, খাঁটি বাঙালি ধাঁচে শাড়ি পরাও শিখিয়েছিলেন স্ত্রীকে এবং পরে স্ত্রী শিখিয়েছিলে শাশুড়িকে। তাঁরা মা মেয়ে বাঙালি জামাইয়ের সংস্কৃতি অনুযায়ী শাড়িতে অত্যন্ত গর্বিত বোধ করতেন।
স্ত্রীকে শিখিয়েছিলেন বিভিন্ন সুস্বাদু বাঙালি রান্না। আট বছরে মধ্যে দুই সন্তানের মা হন তোশিকো বসু। ১৯২০-র ১৩ অগস্ট জন্মায় ছেলে মাশাহিদে, যাঁর ভারতীয় নাম ছিল ভারতচন্দ্র (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মাত্র ২৪ বছর বয়সে দেশের জন্য লড়তে গিয়ে মারা যান তিনি)। ১৯২২-এর ১৪ ডিসেম্বর জন্ম হয় মেয়ে তেৎসুকো-র।
প্রথম সন্তানের জন্মের পর স্ত্রী-পুত্র-শ্বশুর-শাশুড়ির আলোকচিত্র, ভাই বিজনবিহারীর জন্য তোশিকোর হাতে তৈরি একটি মানিব্যাগ, ভাইয়ের বউয়ের জন্য জাপানি শাড়ি, ওড়না ও বাবার জন্য সিল্কের গেঞ্জি পাঠিয়েছিলেন রাসবিহারী। মানিব্যাগটি ১৯৩০ সালে টাকা সমেত চুরি হয়ে যায়। টাকার থেকেও ভাই বিজনবিহারীর বেশি আপশোস হয়েছিল বৌদি তোশিকোর স্মৃতিচিহ্ন হারানোর জন্য।
১৯২৩ সালের ২ জুলাই জাপানের নাগরিকত্ব পান রাসবিহারী। সুন্দর একটা বাড়িতে স্বাধীন জীবন শুরু হয়। তোশিকো আবার নতুন করে সংসার সাজিয়ে বসেন। কিন্তু সেই সুখও স্থায়ী হল না। সেপ্টেম্বরে ভয়ানক ভূমিকম্পে বাড়ি ভেঙেচুরে গেল। আবার তীব্র অর্থাভাবে পড়লেন রাসবিহারী। কিছু টাকা পাঠালেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। … ১৯২৪ সালে টোকিয়োতে তোশিকো-রাসবিহারীর বাড়িতেও গিয়েছিলেন কবি। তত দিনে তোশিকোর শরীর ভেঙে পড়ছে। আট বছরের বিবাহিত জীবনের স্বামীর জন্য প্রচন্ড মানসিক চাপ, রাসবিহারীকে নিয়ে প্রতিনয়ত ভয়-আশঙ্কা এবং অমানুষিক শারীরিক পরিশ্রম শোধ তুলতে শুরু করেছিল। যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, সঙ্গে নিউমোনিয়া। স্ত্রী তোশিকোর বেঁচে থাকার শেষের ক’টা দিন তাঁর বিছানার পাশ থেকে নড়ানো যায়নি রাসবিহারীকে। সারাদিন তাঁর হাতের মধ্যে ধরা থাকত স্ত্রী তোশিকোর হাত। স্মিত হাস্যে তিনি ধীর, ম্রিয়মান কণ্ঠে শ্রীমৎ ভাগমত গীতা থেকে সংস্কৃত মন্ত্র উচ্চারণ করতেন আর তাঁর সঙ্গে ক্ষীণ কণ্ঠে গলা মেলাতেন তোশিকো। সেই ঘরে সেই ক’টা দিন তোশিকোর বাবা-মাও ঢোকেননি, একান্তে থাকতে দিয়েছেন ওঁদের দুটিকে। মাত্র ২৮ বছর বয়সে অকালপ্রয়াণে চিরনিদ্রায় তলিয়ে গিয়েছিলেন তোশিকো বসু।
১৯৪২ সালের ২৮-২৯ মার্চ টোকিওতে সম্মেলনে তিনি ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে একটি সেনাবাহিনী গঠনের প্রস্তাব দেন। সেই মত ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ বা ভারতীয় স্বাধীনতা লীগ গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৪২ সালের ২২ জুন ব্যাঙ্ককে তিনি লীগের দ্বিতীয় সম্মেলনের আহ্বান জানান। এই সম্মেলনে সুভাষচন্দ্র বসুকে লীগে যোগদান ও লীগের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানোর প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগে ও লীগের সশস্ত্র শাখা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মিতে যোগদানে উৎসাহিত করা হয়।
কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে জাপানি সেনা কর্তৃপক্ষের একটি পদক্ষেপে তাঁর প্রকৃত ক্ষমতার উত্তরণ ও সাফল্য ব্যাহত হয়। তবে তার সাংগঠনিক কাঠামোটি কিন্তু থেকে যায়।
তাঁর মৃত্যুর বছর দুয়েক পূর্বে ১৯৪৩ সনে জাপান সরকার বিপ্লবী শ্রী রাসবিহারী বসুকে, যে অভিবাসী জন্মসূত্রে জাপানি নন, সেই তালিকাভুক্ত হিসাবে ওনাকে তাঁদের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান “সেকেন্ড অর্ডার অব দি মেরিট অব দি রাইজিং সান” খেতাবে ভূষিত করেন।
রাসবিহারী বসু জানুয়ারি ২১, ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে জাপানে যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন।
১৯৬৭ সনে তদানীন্তন ভারত সরকার রাসবিহারী বসুর স্মৃতিতে একটি ডাক টিকিটও প্রকাশ করেছিল।
সংকলিত – সুমন ঘোষ
মিসিসাগা
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~ ~~~~
তথ্যসূত্র :
-> ‘বোস অব নাকামুরা’, লেখক: তাকেশি নাকাজিমা;
-> কর্ম্মবীর রাসবিহারী। শ্রীমতি ইলা বসু। (১৯৫৯)।
-> উমা মুখোপাধ্যায় (১৯৬৬)। টু গ্রেট ইন্ডিয়ান রেভোলুশনারিজ।
-> সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, অঞ্জলি বসু (১৯৭৬)। সংসদ বাঙালী চরিতাভিধান।
-> bangla.asianetnews.com
-> লোকেশ ওহরি, হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটি
-> পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়, আনন্দবাজার পত্রিকা। ১৩ অক্টোবর ২০২০।
-> জনৈক স্বপন সেন, ইতিহাসবিদ