বীর সাভারকরঃ
 
(গবেষণাপত্র- সন্দীপ মুখোপাধ্যায়)
 
সাভারকর অল্প বয়সেই বিপ্লবী হয়েছিলেন।মহারাষ্ট্রে বিপ্লবী আন্দোলনে সাভারকর ভ্রাতৃদ্বয় বিনায়ক সাভারকর ও গণেশ সাভারকর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৮৯৯ সালে তাদের উদ্যোগে নাসিকে গড়ে উঠেছিল ‘মিত্র মেলা’ নামক সমিতি।অস্ত্র পরিচালনা, সামরিক শিক্ষা,গোপনে ইংরেজ বিরোধী কাজ পরিচালনা এর মূল লক্ষ্য ছিল।সাভারকর ১৯০৪ সালে গঠন করেন ‘অভিনব ভারত’ নামক বিপ্লবী সমিতি।এই সমিতির প্রধান কাজ ছিল অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা। ভারতের প্রথম তিন শহিদ তিন ভাই দামোদর চাপেকর,বালকৃষ্ণ চাপেকর এবং বাসুদেব চাপেকর ছিলেন সাভারকরের তিন অনুগামী।সাভারকরের বিপ্লবী কাজের জন্য ইংরেজ সরকার তার গ্রেপ্তারী পরোয়ানা জারী করে।এইজন্য সাভারকর লন্ডনে চলে আসেন, বিপ্লবী কাজকর্ম পরিচালনার জন্য।তিনি লন্ডনেও ‘অভিনব ভারত ‘ সংঘ গঠন করলেন।ভারতীয় মাত্রই এই সংঘে যুক্ত হতে পারতেন।সংঘের সাপ্তাহিক সভায় সাভারকর রাশিয়া, ইটালী, ফ্রান্স,আমেরিকা, জার্মানি ইত্যাদি দেশের রাষ্ট্র বিপ্লবের ইতিহাস ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করতেন। ভারত জননীর বিপ্লব নন্দিনী ভিকাজী কামা সাভারকরের বিপ্লবদলে আত্মনিয়োগ করেন। একে একে রবি শংকর শুক্ল,হেমচন্দ্র নাগ,স্যার সেকেন্দার হায়াতখাঁ, ভি,ভি,এস আয়ার,লালাহরদয়াল সাভারকরের দ্বারা প্রেরণা লাভ করেন। 
 
1857 সালের মহাবিদ্রোহের উপর ‘ভারতের স্বাধীনতার যুদ্ধ ‘গ্রন্থটি সাভারকর রচনা করেছিলেন।তখন তিনি বিদেশ থেকে সাহায্য নিয়ে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন কে জোরদার করার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করেছেন। 
 
সাভারকরের মতে,১৮৫৭ সালের সংগ্রাম যে দুটি মহৎ আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল,সে দুটি পথ হল ‘স্বধর্ম ‘ও ‘স্বরাজ’। লক্ষ্মীবাঈ, নানাসাহেব,তাঁতিয়া টোপী প্রমুখের নির্ভীক সাহসিকতার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন সাভারকর তাঁর গ্রন্থটিতে। অভিনব ভারত মারাঠি এবং হিন্দি ভাষায় গ্রন্থটির অনুবাদ করে ভারতের সর্বত্র বিপ্লবী ভাবধারা প্রচার করতে থাকে।লন্ডনে ব্রিটিশদের সন্দেহের তালিকায় সাভারকরের নাম চলে আসে। বিশেষ করে নানাসাহেব কে নিয়ে তাঁর মূল্যায়ন এবং ব্রি টিশ দের বিরুদ্ধে তার রণকৌশল ব্রিটিশদের চিন্তিত করে তোলে।
 
নানাসাহেবের মূল্যায়ন করতে গিয়ে সাভারকর এই মত ব্যক্ত করেন যে,তিনি একটি অখণ্ড ভারতবর্ষ গঠন করার জন্য ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ সংগ্রামের পক্ষপাতী ছিলেন। লক্ষ্মীবাঈ এর নারী বাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন,স্বাধীনতা আন্দোলনে পুরুষদের পাশাপাশি যে নারীরও ভূমিকা রয়েছে তা তিনি তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। শুধু তাই নয় হিন্দু মুসলিম একতা না আসলে যে স্বাধীনতার আন্দোলন সর্বাত্মক  হবেনা তা তিনি উল্লেখ করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ সংগ্রাম করার জন্য  উদান্ত কণ্ঠে আহ্বান জানিয়েছিলেন এই বলে যে,’ মুসলমানরা, যদি তোমরা কোরান- কে শ্রদ্ধা করো,আর হিন্দুরা, যদি তোমরা গোমাতাকে পুজো করো,তাহলে তোমাদের তুচ্ছ পার্থক্যের কথা ভুলে পবিত্র এই মুক্তিযুদ্ধে শামিল হও’।বিপ্লবের পথ এবং কৌশল কি হতে পারে সেই বিষয়ে গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন সাভারকর। তাঁর ভাষায়,’শান্তিপূর্ণ আন্দোলন নয়,বিপ্লবের জন্য প্রয়োজন শুকনো বারুদ,কামান ও নির্ভীক সেনা’।বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য বাহুবলকে আশ্রয় করে সন্ত্রাস পরিচালনা এবং প্রয়োজনে বিদেশ থেকে সাহায্য নিয়ে আন্দোলন পরিচালনা করতে হবে।
 
লন্ডনে সাভারকরকে ব্রিটিশরা ‘শ্রেণী শত্রু’ হিসেবে চিহ্নিত করে।১৯০৯ সালে সিপাহী- বিদ্রোহ দমনের ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ায় ব্রিটিশ সরকার লন্ডনে বিজয় উৎসব উদযাপন করে। জনসভায় নানা সাহেব, তাঁতীয়া টোপী, লক্ষ্মীবাঈ, মৌলানা মহম্মদ সাহেব,কুমার সিং প্রমুখ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের দেশদ্রোহী, রাজস্ব লুণ্ঠনকারী ঘোষণা করা হয়।
 
প্রতিবাদে ২১ শে মার্চ সাভারকর ইন্ডিয়া হাউসে তাঁর বইয়ের অংশবিশেষ পাঠ করেন।১২ ই এপ্রিল সাভারকর তাঁর ভাষণে ভারতীয় সিপাহিদের বীরত্ব ও ইংরেজদের কাপুরুষতার কথা বিশদভাবে উল্লেখ করেন। ৯ই মে’র মিটিং – এ সাভারকর জ্বালাময়ী বক্তৃতায় নানা সাহেব,লক্ষ্মীবাঈ ও অন্যান্যদের বীরত্ব ও স্বদেশ প্রেমের বর্ণনা দিয়ে উপস্থিত সকলকে ১ মাস ধরে ” বিদ্রোহ ব্যাজ”পরার জন্য অনুরোধ জানালেন।
জাতীয় এই অবমাননার প্রতিবাদে সাভারকর মহাবিদ্রোহ ঘোষণার তারিখ ১০ই মে, লন্ডনে স্বাধীনতা দিবস পালন করেন। ‘Honours to the martyrs of 1857’ লিখিত ব্যাজ  ধারণ করে সর্বত্র প্রতিবাদ জানান হয়।
 
যাইহোক, মদনলাল ধিংড়া, সাভারকরের পরিকল্পনা অনুসারে ১ লা জুলাই ১৯০৯ স্যার কার্জন উইলিকে (ইংরেজ রাজপুরুষ) লন্ডনে হত্যা করেন। মদনলালের ফাঁসি হয়।সাভারকর ধরা পড়েন। ১৯০৯ সালে ২১ডিসেম্বর অনন্ত লক্ষণ নাসিকের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জ্যাকসনকে হত্যা করেন, তিনি ছিলেন অভিনব ভারতের সদস্য। শুরু হয় নাসিক ষড়যন্ত্র মামলা (১৯১০-১৯১১)।বিচারের রায়ে নারায়ণ দেশপান্ডে, অনন্ত লক্ষণ কানহারে, কৃষ্ণগোপাল কারভ প্রমুখের ফাঁসি হয়। সাভারকরকে ২৬ বছরের জন্য কারাদণ্ড দিয়ে আন্দামানের সেলুলার জেলে পাঠানো হয়।অভিনব ভারতের সদস্য মদনলাল ধিংড়া বলেছিলেন, “The only lesson required in India is to learn how to die and the only way to teach it is by dying along. “
 
সাভারকর নিজের বৈপ্লবিক জীবন শুরু করেছিলেন অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে। ‘অখণ্ড ভারত অমর রহে ‘ ধ্বনি ছিল তার মূলমন্ত্র। জাপানে হিন্দুমহাসভার সভাপতি রাসবিহারী বসু সাভারকরকে অভিনন্দিত করিয়া বলেছিলেন, ‘I am saluting the symbol of sacrifice itself, oh,savarkar,your leadership is the greatest hope in India’………….যদিও তিনি এই মন্তব্য করেছিলেন ১৯৩৭ সালের ১০ ই মে, সাভারকরের ২৭ বছর নির্বাসিত জীবন অতিবাহিত করার পর মুক্তিলাভের পর।
 
সাভারকরের বন্দীজীবন নিয়ে, কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট লেখক এবং ইতিহাসবিদগণ অনেক মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। কিন্তু আসল সত্য হল বন্দীদশাতেই সাভারকর ঠিক করে নিয়েছিলেন তার পরবর্তী পদক্ষেপ। আন্দামানে থাকাকালীন আন্দামানে বন্দীদের উপর অকথ্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হন সাভারকর। পাশে পেয়েছিলেন ভাই পরমানন্দ, উপেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি,উল্লাসকর দত্ত,আশুতোষ লাহিড়ী প্রমুখকে।উল্লাসকর দত্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “সরিষার তৈলের প্রতি ঘানিতে তিনটি করিয়া নরদেহ বাঁধিয়া দেওয়া হইত।দিনে বারো ঘণ্টার মধ্যে মাত্র কয়েক মিনিট আহারের জন্য সময় পাওয়া যাইত, ইহা ভিন্ন সব সময় ঘানির চারিদিকেই দ্রুত পদে ঘুরিতে হইত।যদি কেহ শ্রান্ত ক্লান্ত অবসন্ন দেহে পড়িয়া যাইত বেত্রাঘাতে জর্জরিত করিয়া গাত্রোত্থানে বাধ্য করিত।যদি কেহ একান্তই উঠিতে না পারিত তাহাকে চলমান ঘানিতে বাঁধিয়া দিত-দেহ -ক্ষত বিক্ষত রক্তাক্ত হইয়া যাইত”।অখাদ্য খাবার গ্রহনে একপ্রকার বাধ্য করা হত,ম্যালেরিয়া এবং উদরাময় ব্যাধি হয়ে অনেকে মারা যেত। 
 
হৃষীকেশ সান্যাল ‘বিপ্লবী বীর সাভারকর’ গ্রন্থে লিখেছেন,’ ডি’- লৌহফলক’ গরম করে সাভারকরের বুকে গাঁথিয়া দেওয়া হয়েছিল।গুপ্ত পদ্ধতিতে সেই খবর বাহিরে প্রকাশ পেতে বেশি সময় লাগলো না। সাভারকর প্রেরিত এইসব গুপ্ত সংবাদ সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি তার ‘বেংগলী’পত্রিকায়, প্যারিসে পণ্ডিত শ্যামবর্মা তাহার ‘বোম’ পত্রিকায়, মাদাম কামা ‘বন্দেমাতারম’ পত্রিকায়,আল্ড্রাড ওয়ার্ড পত্রিকায় প্রকাশ করিলেন এবং হরদয়াল আমেরিকার ‘গদর’ পত্রিকায় ঘানিতে নিযুক্ত সাভারকরের ছবি বিবরণসহ প্রকাশ করিলেন।
 
বন্দীগণ সংঘবদ্ধভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন এবং পুনঃ পুনঃ ধর্মঘট আরম্ভ করিলেন।উপায়ন্তর না দেখে ভারত সরকারের তদানিন্তন ‘হোম মেম্বার’ স্যার রেজিল্যাণ্ড ১৯১৪ সালে ১৬ ই নভেম্বর সাভারকরের সহিত সাক্ষাৎ করেন। এর ফলস্বরূপ আন্দামান কারা ব্যবস্থার সংস্কার করা হয়;রাজনৈতিক বন্দীদের প্রতি অত্যাচারের মাত্রা শিথিল করা হয়।
 
বোম্বাইয়ের ‘ন্যাশনাল ইণ্ডিয়ান’ বীর সাভারকরের মুক্তির জন্য ভারত সরকারের সেক্রেটারীর নিকট আবেদন জানিয়েছিল। ১৯২০ সালের ফেব্রুয়ারীর শেষ দিকে বিঠল ভাই প্যাটেল এবং দাদা সাহেব খাপারদে লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে  সাভারকরের মুক্তি দাবী করে পত্র প্রেরণ করেছিলেন। গান্ধীজীও’ ইয়ং ইণ্ডিয়াতে’ সাভারকর ভ্রাতৃদ্বয়ের মুক্তি সমর্থন করে প্রবন্ধ প্রকাশ করিতেন। ভারতবাসী সাভারকর সপ্তাহ পালন করিয়া দিকে দিকে দাবী তুলিল -‘সাভারকরের মুক্তি চাই’।অখিল ভারত জাতীয় মহাসভার অধিবেশনেও সাভারকরের মুক্তি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল।গণস্বাক্ষর পত্রেও মুক্তি দাবী জ্ঞাপন করা হয়েছিল। উক্ত গণপত্রে স্বাক্ষর করিবার জন্য পণ্ডিত নেহরুর নিকট পেশ করা হলে নেহরু স্বাক্ষর করতে অসম্মত হন।তথাপি যমুনাদাস মেটার প্রচেষ্টায় ৭০ হাজার বিশিষ্ট ব্যক্তি স্বাক্ষর করিয়া ভারত সরকারের নিকট আবেদন জানিয়েছিলেন সাভারকরের মুক্তির জন্য। 
 
ক্রমশ সাভারকর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভাই পরমানন্দ ১৯২০ সালের শেষদিকে আন্দামান হইতে মুক্তিলাভ করেন। সেই সময় col wedge wood নামে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের প্রভাবশালী সদস্য ভারতে আগমন করেন। সাভারকরের মুক্তির জন্য ভাই পরমানন্দ তাহাকে বিশেষভাবে প্রভাবান্বিত করেন। wedge wood এর একান্ত প্রচেষ্টায় সাভারকরের প্রতি প্রদত্ত’ ডিটিকেট’ প্রত্যাহৃত হয়েছিল ১৯২১ সালের ১০ ই ফ্রেব্রুয়ারী। মে মাসে সাভারকর ভ্রাতৃদ্বয় আন্দামান থেকে কলিকাতায় আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে স্থানান্তরিত হলেন এবং এখান থেকে গণেশ সাভারকর বিজাপুর জেলে এবং বিনায়ক সাভারকর রত্নগিরি জেলে স্থানান্তরিত হলেন।
 
বীর সাভারকর রত্নগিরিতে থাকাকালীন হিন্দুত্বের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেন এবং তিনি তার ‘হিন্দুত্ব ‘পুস্তকখানি রত্নগিরি কারাগারেই রচনা করেছিলেন। তিনি রত্নগিরিতে থাকাকালীন সমাজ সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন।সাভারকর অনুধাবন করেছিলেন, ভারতীয় সমাজের জাতিভেদ প্রথা সিন্ধুর অধিবাসীদের এক হতে দেয়নি। এইজন্য মুসলমান, ইংরেজদের নিকট বারে বারে হিন্দু জাতিকে লাঞ্ছিত হতে হয়েছে। তিনি সমস্ত বন্দীদের থেকে চাঁদা তুলতে আরম্ভ করলেন।এইভাবে রত্নগিরির ভিতর প্রতিষ্ঠিত হল শ্রীপতিপাবন মন্দির। মন্দির প্রতিষ্ঠা দিবসে ব্রাহ্মণ -চণ্ডাল সকলে একসাথে অঞ্জলি প্রদান করিলেন। তিনি ব্রাহ্মণ -অব্রাহ্মণ -মুচি -মেথর -চণ্ডাল -অচ্ছুৎ এইসকল জাতিপ্রথা দূর করে সকলের পরিচয় ‘হিন্দু’এই অখণ্ড আদর্শ প্রচার করতে লাগলেন। রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ এবং মুসলিম সমাজ কিন্তু প্রচণ্ড রুষ্ট হয়েছিল সাভারকরের উপর। কারণ তিনি জেলের ভিতর শুদ্ধি আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সাভারকর উদান্ত কণ্ঠে আহ্বান জানালেন,”স্বধর্ম ত্যাগ করিবার অর্থই হইল জাতীয়তা ত্যাগ করা ;জাতীয়তা বিরোধী কাজ অবশ্যই বন্ধ করিতে হইবে। একজন হিন্দু ধর্মান্তরিত হওয়ার অর্থ  এক পদক্ষেপ মাতৃভূমি পর পদানত হওয়া।”
 
মহাহিন্দুজাতি গঠন করাই ছিল সাভারকরের জীবনব্রত। তাহার নির্দেশেই রত্নগিরি মহাসভা নিখিল বিশ্ব হিন্দু আন্দোলন (pan Hinduism) প্রবর্তন করে।হিন্দুমহাসভার গৈরিক পতাকার পরিকল্পনা সাভারকর রত্নগিরি হতে প্রেরণ করেছিলেন।
 
সাভারকরের নীতি ছিল, ভারত স্বাধীন হওয়ার পর সকলের সমান ভোটাধিকার থাকবে, জাতপাত বলে কিছু থাকবেনা, একটিমাত্র রাষ্ট্রভাষা থাকবে, তা হবে দেবনাগরী অক্ষরে হিন্দী।ভারত হবে ধর্মনিরপেক্ষ।
 
১৯২৩ সালে মে  মাসে ৩ য় মহারাষ্ট্র অধিবেশনে সাভারকরের মুক্তিদাবী প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় এবং সাভারকর “রিলিজ কমিটি ” গঠিত হয়। সেপ্টেম্বর মাসে বোম্বাই শহরে এক বিরাট জনসভায় পুনরায় তার মুক্তিদাবী জ্ঞাপন করা হয়।
 
ডিসেম্বর মাসে বোম্বাইয়ের গভর্নর স্যার জর্জলয়েড সাভারকরের সহিত তাহার মুক্তি নিয়ে আলোচনা করেন এবং শর্তসাপেক্ষ মুক্তিদানে সন্মত হন। কিন্তু সাভারকর এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।শেষ অবধি বোম্বাইয়ের অর্থমন্ত্রী যমুনাদাস মেটার আন্তরিক চেষ্টায় ১৯৩৭ সালের ১০ ই মে সুদীর্ঘ  ২৭ বছর নির্বাসিত জীবন যাপন করার পর এই বীর বিপ্লবী মুক্তি লাভ করেন।
 
তিলকের ছাত্র তথা অনুগামী  মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে লিখেছিলেন ‘ইন্ডিয়ান ওয়ার অফ ইন্ডিপেন্ডেন্ট’ গ্রন্থটি।প্রথম দিকে গ্রন্থটির বিবরণ দিয়েছিলাম।এখানে আরও কিছু অংশ সংযোজন দরকার মনে করি।কারণ সাভারকরের জাতীয়তাবাদী ভাবনা অনুধাবন করতে হলে বিশদ ব্যাখ্যা প্রয়োজন। সাভারকর নিজের  গ্রন্থে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জোটবদ্ধ স্বাধীনতা সংগ্রাম, দেশ প্রেম ও জাতীয়তাবাদের কথা তুলে ধরেন।সাভারকর নিজ বইতে উল্লেখ করেছেন ইসলাম ও হিন্দুদের নিয়ে ভারতে গঠিত হবে এক মহান জাতি।ইংরেজদের বিরুদ্ধে সাম্যের মাধ্যমে সংগ্রাম করার জন্য সাভারকর উদাত্ত কন্ঠে আহ্বান জানিয়েছিলেন এই বলে যে, “মুসলমানরা, যদি তোমরা কোরান-কে শ্রদ্ধা করো, আর হিন্দুরা, যদি তোমরা গোমাতাকে সন্মান করো,তাহলে তোমাদের তুচ্ছ পার্থক্যের কথা ভুলে পবিত্র এক একতার বন্ধনে আবদ্ধ হও’।
 
ইতোমধ্যে মুসলিম লীগ তার সম্প্রদায়গত চেতনা বিস্তারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে।হিন্দু মুসলমান আলাদা জাতি এই ধারণা অনেক পরে এলেও, লীগের আক্রোশ ছিল কংগ্রেসের উপর; ইংরেজদের প্রতি তাদের রাগ ছিলনা বললেই চলে। তারা,চেয়েছিল নিজেদের জন্য আলাদা প্রতিষ্ঠান। লীগ কংগ্রেসকে একপ্রকার হিন্দুত্ববাদী সংগঠন হিসেবেই দাবী করত। ১৯০৬ এর ৩১ ডিসেম্বর মুসলিম লীগের উদ্দেশ্য সম্পর্কিত ভাষণে ঢাকায় বলা হয়,-
১)ব্রিটিশ সরকারের প্রতি মুসলমান সম্প্রদায়ের সমর্থন সুনিশ্চিত করা,
২)একমাত্র মুসলিম সমাজের স্বার্থ রক্ষা করা,
৩)জাতীয় কংগ্রেসের প্রভাব প্রতিপত্তি বিলোপ করা,
৪) আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে মুসলিমদের ব্রিটিশ অনুগত করা,
৫)অন্য সম্প্রদায়ের সাথে সংঘাতে না যাওয়া।
 
বলা বাহুল্য,এই শেষ লক্ষ্যটি ছিল সম্পূর্ণ লোক দেখানো ব্যাপার। ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী বলেছেন,”জন্মলগ্ন থেকে ব্রিটিশ আনুগত্যের ধ্বজা উড়িয়ে লীগ হয়ে উঠেছিল মুসলিম জমিদার ও জোতদার শ্রেণীর সংকীর্ণ স্বার্থ রক্ষক, মধ্যবিত্তের প্রতি উদাসীন এবং চরম হিন্দু- বিদ্বেষী একটি প্রতিষ্ঠান(“pro-Landlord and pro-British and anti-bourgeois and anti -Hindu’)।লীগের মদতে এ সময় বাংলায় হিন্দুদের উপর মাত্রাতিরিক্ত আক্রমণ চলতে থাকে। ফলে কংগ্রেসের মধ্যেই একপ্রকার চরমপন্থী মতবাদের আবির্ভাব ঘটে ;যারা ব্রিটিশ এবং মুসলিম লীগের তীব্র বিরোধী ছিল।
 
কিছুটা চরমপন্থীদের জব্দ করা এবং মুসলিমদের হাতে রাখার উদ্দেশ্যে ১৯০৯ সালে সরকার ম-মিন্টো শাসন সংস্কার প্রবর্তন করে। এর দ্বারা মুসলিমদের জন্য আলাদা নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হয়। স্থির হয় যে, মুসলিমদের জন্য সংরক্ষিত আসনে মুসলিম ভোটাররাই মুসলিম প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করবেন।এইভাবে প্রশাসনে দ্বিজাতিতত্ত্ব তৈরি করে দেওয়া হল। কংগ্রেস এই সময়ে উদাসীন ছিল, হিন্দুদের ব্যাপারে, কারণ কংগ্রেস যে ধর্মনিরপেক্ষ দল তা প্রমাণ করতে কংগ্রেস বেশি সচেষ্ট ছিল। ডঃ তারা চাঁদ বলেছেন যে, ম-মিন্টো শাসন সংস্কারের পর হিন্দুদের রক্ষা তথা হিন্দুদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে কংগ্রেসের হিন্দুদের একাংশ ‘হিন্দু মহাসভা ‘প্রতিষ্ঠা করে। মদনমোহন মালব্য,লালা লাজপত রাই,বাল গঙ্গাধর তিলক ছিলেন এই সভার প্রথমসারির নেতা।
 
১৯১২ সালের পর লীগের দায়িত্ব পান আলি জিন্না,সউকত আলি, ওয়াজির হাসান, হসরত মোহানি, হাকিম আজমল খান। এইসময়ে লীগ মুসলিম স্বার্থ সংরক্ষনে বিশেষ যত্নবান হয়। 
 
ইতোমধ্যে ১৯১৫ তে হিন্দু মহাসভার প্রথম সাধারণ সম্মেলন হয়। ১৯১৬ সালে জাতীয় কংগ্রেসের Lucknow অধিবেশনে জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের মধ্যে Lucknow চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি দ্বারা কংগ্রেস মুসলিম সম্প্রদায়ের আলাদা নির্বাচনের দাবি মেনে নেয় এবং বিভিন্ন প্রাদেশিক আইনসভা ও কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিমদের জন্য নির্দিষ্ট  পরিমাণ আসন সংরক্ষণ ব্যবস্থায় সন্মত হয়। 
 
হিন্দুদের অস্তিত্ব সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিল। চারিদিকে লীগের সদস্যরা দাঙ্গা শুরু করে। ইতিমধ্যে ১৬ টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটে।
 
জেলে বসে সবই লক্ষ্য করছিলেন সাভারকর। তিনি অনুধাবন করেন যে, হিন্দুদের এই দুর্দিনে একমাত্র তাদের রক্ষাকবচ হতে পারে তাদের অখণ্ড হিন্দুত্ব নীতি। সমাজে হিন্দুদের মধ্যে ভেদাভেদ হিন্দু একতার পথে প্রধান অন্তরায়। তাই এক জাতিভেদ মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা আবশ্যক। ১৯২৭ সালে সাভারকরের লিখিত দি স্টোরি অফ মাই ট্রান্সপোর্টেশন ফর লাইফ গ্রন্থটি প্রকাশ পায়, যাতে এই দিকগুলি নিয়ে বিশেষ আলোচনা করা হয়েছে। 
 
১৯২৩ সালে সাভারকরের বিখ্যাত গ্রন্থ হিন্দুত্ব :হু ইজ আ হিন্দু প্রকাশ পায়। এখানে তিনি হিন্দুত্ব এবং জাতীয়তাবাদ নিয়ে আলোচনা করেছেন যা পরবর্তীকালে বামপন্থী ইতিহাসবিদ এবং লেখকরা অন্যভাবে পরিবেশিত করেছেন। 
 
আসলে হিন্দুদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ জাগ্রত করার জন্য তিনি নিজ বইতে Fatherland এবং Holyland ধারণার অবতারণা করেছেন।পারসি, খ্রিস্টান সব সম্প্রদায়ের সহিত উদারতার সম্পর্ক স্থাপনের কথা তিনি বলেছেন। প্রথমদিকে তিনি মুসলিমদের প্রতিও উদার ছিলেন, কিন্তু লীগ যখন থেকে হিন্দুদের উপর অত্যাচার চালাতে থাকেন, তখন তিনি মুসলমান সম্প্রদায়কে কিছুটা সজাগ করতে চেয়েছিলেন। হিন্দুত্বের তিনটি বন্ধনের কথা তিনি বলেন -‘রাষ্ট্র ‘,’জাতি’ এবং” সংস্কৃতি”। সাভারকরের মধ্যে হিন্দুত্বের ধারণা  Hinduism ধারণার থেকে বিস্তৃত এবং অধিকভাবে ব্যাপক। তারকাছে হিন্দুত্ব ও জাতীয়তাবাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। তিনি লিখেছেন, “A Hindu patriot worth the name can’t but be an Indian patriot as well.To the Hindus, Hindustan being the Fatherland and Holy-land, the love they bear to Hinduism is boundless, That is why they predominate in the national struggle that is going on for the overthrow of the British yoke.”
 
হিন্দু মহাসভার কর্মের পরিধি বোঝাতে গিয়ে সাভারকর বলেছেন, মহাসভা প্রধানত একটি হিন্দু ধর্মের সভা নয়,এটি প্রধানত হল একটি হিন্দু- রাষ্ট্র সভা এবং প্যান হিন্দু সংগঠন, যা সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিকগুলোকে নিয়ে একটি হিন্দু জাতির ভাগ্য নির্ধারণ করবে। যেসমস্ত হিন্দুরা ইসলাম গ্রহণ করে মুসলিম হয়েছিলেন, তাদের তিনি হিন্দু ধর্মে ফেরার আহ্বান জানান। কিন্তু যারা জাতীয়তাবাদ বিরোধী এবং হিন্দুদের উপর আক্রমণ করতে থাকে তাদের উদ্দেশ্যে হিন্দুত্বের বাণী প্রচার করেন। কিন্তু বামপন্থী ইতিহাসবিদগণ  সাভারকরের হিন্দুত্ব নীতিকে বিকৃত করে প্রচার চালান। বিশিষ্ট কমিউনিস্ট লেখক a j নুরানি মন্তব্য করেছেন, ‘যে শক্তিশালী 
জাতীয়তাবাদী শিখা সাভারকর প্রজ্বলিত করেছিলেন, সেটি ছিল হিন্দু জাতীয়তাবাদ, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নয়”।অমর্ত্য সেন অনুরূপ মন্তব্য করেছেন।
 
১৯২৫ সালে সাভারকরের নির্দেশিত পথে লালা লাজপত রাই হিন্দু মহাসভার কাজের পরিধি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেন। স্থির হয়,
 
১)দেশের সব জায়গায় হিন্দুমহাসভা সংগঠন গড়ে তুলতে হবে, 
২)দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুদের সাহায্য করতে হবে,
৩)শুদ্ধি আন্দোলন দ্বারা হিন্দুদের ঘরে ফেরাতে হবে,
৪)সেবা সমিতি সংগঠন
৫)হিন্দী ভাষার প্রসার কারণ এটি ইন্দো আর্য ভাষার রূপ।
৬)সমাজে জাতিভেদ দূর করতে হবে। সবার পরিচয় হবে সে হিন্দু, এইজন্য সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষজনকে, অচ্ছুৎ বলে সরিয়ে রাখা মানুষদের ক্ষত্রিয় পরিচয় দিয়ে সমাজের সামনের সারিতে নিয়ে আসতে হবে,
৭)মুসলিম,খ্রিস্টান, পারসি এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের সহিত ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে।
৮)নারীদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার এবং তাদের উন্নয়ন,ইত্যাদি। 
 
সাভারকর হিন্দু মন্দিরে যাতে সবাই প্রবেশ করতে পারেন তার সপক্ষে মত প্রকাশ করেন। ১৯৩০ সালে তিনি এক ‘সহভোজন’এর ব্যবস্থা করেন। এই অনুষ্ঠানে সাভারকর ঘোষণা করেন, “From today I shall not believe in highness or Lowness of caste.I shall not oppose the inter-marriage between the highest and the lowest castes’
 
 ১৯২৩ থেকে ২৬ সালের মধ্যে ভারতে ৭২ টি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। এর কারণ হিসেবে রমেশচন্দ্র মজুমদার দায়ী করেছেন -(১)সারা ভারতে মুসলিম লীগের গোঁড়া নেতাদের প্রেরণা, (২)অনুন্নত মুসলিমদের শিক্ষার অভাব, যারা এই সময় রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় মেতে উঠেছিলেন,(৩)সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তির সাম্প্রদায়িক উস্কানি।
 
ইতোমধ্যে মহাসভা হিন্দুদের একতার উপর জোড় দেয়। কারণ হিন্দুদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ  জাগ্রত করতে না পারলে, চরমপন্থী মুসলমান এবং ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধতা করা সম্ভব ছিলনা।
 
তাই হিন্দু মহাসভা, নিম্ন হিন্দু, উচ্চ হিন্দু এই জাতিভেদ ঘোচাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়।এইসময়ে হিন্দু মহাসভায় লালা লাজপত রাই, রাসবিহারী বসু, গঙ্গাধর তিলক, বিপিনচন্দ্র পালের বিশেষ প্রভাব ছিল; যদিওবা বিপিনবাবু এবং গঙ্গাধর তিলকের মধ্যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে মতভেদ লক্ষ্য করা গিয়েছিল। গদর দল এবং হিন্দু মহাসভার আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল রাসবিহারী বসুর উদ্যোগে।
 
ম্যাৎসিনির জীবন,অরবিন্দের বন্দেমাতরম পত্রিকা, Bankim এর আনন্দমঠ, বারীন্দ্রকুমারের যুগান্তর পত্রিকা,স্বামীজির বাণী হিন্দু মহাসভাকে অনুপ্রাণিত করেছিল।মার্কিন সাংবাদিক ভ্যালেন্টিন চিরোল ‘unrest India’ গ্রন্থে বলেছেন, বাংলা, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাবের আন্দোলন ছিল একটি ‘হিন্দু বিদ্রোহ ‘।কমিউনিস্ট ইতিহাসবিদগণ আবার এই সময়কার  বিদ্রোহীদের সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়েছেন। গান্ধীজীর জীবনীকার জুডিথ এম ব্রাউন লিখেছেন, “The terrorists themselves were a were a courious product of Hindu orthodoxy and Western education.”বলা বাহুল্য জাতীয় কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার সদস্যগণ সবাই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত।কিন্তু এই আখ্যা শুধু দেওয়া হয় কংগ্রেসকে  বাদ দিয়ে অন্যান্যদের। 
 
ইতোমধ্যে গঙ্গাধর তিলককে ব্রিটিশরা বিপজ্জনক বিপ্লবী আখ্যা দিয়েছে।’ স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার ‘বিপ্লববাদের  এক সংগ্রামী নায়ক হিসেবে তিলককে প্রতিষ্ঠা করেছে। তখন তিনি চরমপন্থী এবং সক্রিয় হিন্দু মহাসভার নেতা। ইতিমধ্যে হিন্দু মহাসভায় আসেন রাসবিহারী বসু। ‘দিল্লি ষড়যন্ত্র ‘মামলায় তিনি তখন গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন। রাসবিহারী লাহোর, দিল্লি, বেনারস ও বাংলার সামরিক ছাউনির জওয়ানদের দেশ জুড়ে সামরিক অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা চালান।কিন্তু পুলিশ গোপনসূত্রে এই পরিকল্পনা জেনে গেলে রাসবিহারী পি,এন ঠাকুর ছদ্মনামে জাপানে পালিয়ে যান। জাপানে তিনি হিন্দু মহাসভার আদর্শ প্রচার করতে থাকেন, এবং জাপানে হিন্দু মহাসভার আজীবন সভাপতি ছিলেন তিনি।
 
ইতোমধ্যে সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধতা করতে গিয়ে লাঠির আঘাতে আহত হন লালা লাজপত রাই। কিছুদিন পর হিন্দু মহাসভার এই বীর নেতার প্রয়াণ ঘটে। মহম্মদ ইকবাল, ফজলি হোসেন, ফিরোজ খাঁ নুন সাইমন কমিশনের পক্ষে ছিলেন।
 
গঙ্গাধর তিলক এবং লালা লাজপত রাইয়ের প্রয়াণ, রাসবিহারীর জাপানে চলে যাওয়া, হিন্দু মহাসভা থেকে বেরিয়ে এসে আর.এস.এস এর প্রতিষ্ঠা কিছুটা হলেও হিন্দু মহাসভার সংগঠনকে দুর্বল করে তুলেছিল।
 
তাই ১৯২৫ থেকে ৩০ এই সময়ে হিন্দু মহাসভা আত্মনিয়োগ করে সামাজিক আন্দোলন তথা বর্ণভেদ, জাতিভেদ ইত্যাদি প্রথার বিরুদ্ধতা করে একতাবদ্ধ জাতীয়তাবাদী চেতনা বিস্তারে।বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দু মহাসভার সংগঠন গড়ে তুলবার প্রয়াস ঘটে। বঙ্গদেশের মালদা, ঢাকা,বর্ধমান, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ ইত্যাদি অঞ্চলে সামাজিক সংস্কারে ব্রতী হয় হিন্দু মহাসভা। আদিবাসীদের প্রথম সারীতে নিয়ে আসার এবং তাদের ক্ষত্রিয় বলে পরিচয় দেওয়ার রীতির প্রচলন ঘটায় হিন্দু মহাসভা। শরৎ  বসু,আনন্দমোহন পোদ্দার, মেহেরচাঁদ খান্না, মহেশ্বর দয়াল শেঠ, রায় সাহেব আরোরা, ধামধের, রাজা নারায়ণলাল বনসীলাল প্রমুখ হিন্দু মহাসভার দায়িত্বে ছিলেন। শ্যামাপ্রসাদজির আগমন তখনও হিন্দু মহাসভায় ঘটেনি।
 
হিন্দু মহাসভার সামাজিক আন্দোলনে সামাজিকভাবে  বঞ্চিত শ্রেণী এক মুক্তির স্বাদ খুঁজে পেলেন।যে সমস্ত হিন্দু এবং মুসলমান জমিদার তাদের পদানত করে রেখেছিল, তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। আর্য  সমাজের সাথে হিন্দু মহাসভার এই অন্ত্যজ আন্দোলন সমাজে হিন্দু মহাসভার গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বাড়িয়ে তুলছিল।
 
ইতোমধ্যে ১৯৩২ সালে ম্যাকডোনাল্ডের ‘সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারা’ নীতি ঘোষণা করা হয়। এর বিরুদ্ধতা করে হিন্দু মহাসভা ‘বাঁটোয়ারা – বিরোধী ‘দিবস পালনের ডাক দিয়েছিল-উল্লেখ্য, এই সময় কংগ্রেসে এই বাঁটোয়ারাকে ‘গ্রহণও নয়,বর্জনও নয়’ এমন একটি বিচিত্র অবস্থান নেওয়া হয়েছিল। এই বাঁটোয়ারার সবচেয়ে আপত্তিজনক অঙ্গ ছিল দুটি :প্রথমত,’হিন্দু ‘এবং ‘অনুসূচিত জাতি’এই দুটি শ্রেণীকে আলাদা করে দেওয়া, যদিও মুসলমানদের ক্ষেত্রে ‘শিয়া ‘এবং ‘সুন্নী’র মধ্যে কোনো প্রভেদ মানা হয়নি;এবং দ্বিতীয়ত,’ইউরোপীয়ান গ্রুপ’-কে একটি বিসদৃশ সংখ্যার বেশি আসন দেওয়া। এরই ফলে নাজিমুদ্দিনের সরকার সংখ্যালঘু দল হলেও ইউরোপীয়দের সমর্থন নিয়ে গদিতে বসেছিল। সমাজের জাতপাত আন্দোলনের ক্ষেত্রে হিন্দুমহাসভার পক্ষে এক বিরাট ধাক্কা বলা যেতে পারে এই নীতি। কংগ্রেসের এই বিমাতৃসুলভ আচরণ হিন্দুমহাসভাকে কংগ্রেস হতে দূরে সরিয়ে দেয়। গান্ধী এবং কংগ্রেসকে হিন্দুমহাসভা ‘মুসলিম তোষণ নীতির’ দায়ে অভিযুক্ত করে।এতক্ষণ বিশদভাবে আলোচনা করলাম।
 
 জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর  ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়েই সাভারকর ঝাঁপিয়ে পড়লেন দেশধর্ম পালনে। ১৯৩৭ সালে সাভারকর হিন্দু মহাসভার এলাহাবাদ সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হন। সাভারকর মন্তব্য করেন, ‘কংগ্রেসী বন্ধুগণের ত্যাগ,নিষ্ঠা, দেশসেবা সন্দেহের অতীত কিন্তু তাহাদের নীতিটাই ভ্রান্ত এবং এই ভ্রান্তনীতিই ভারতের বিপর্যয় ঘটাইবে’।তিনি ঘোষণা করেন, হিন্দুর সহিত একত্র হইয়া দেশ ও জাতির কল্যানকর গঠনমূলক কাজ করিবার ইচ্ছা কি ভারতীয় মুসলমানদের আছে? কংগ্রেসের মুসলিম তোষণ নীতি এবং ভারতীয় কমিউনিস্টগণের জাতীয়তাবিহীন আন্তর্জাতিকপ্রীতির ফলে হিন্দুদের জাতীয় জীবন বিপন্ন হয়েছে বলে সাভারকর মন্তব্য করেন।তিনি ঘোষণা করলেন,”আমি হিন্দুস্থানকে ভালবাসি বলিয়াই মানবতাকে ভালবাসি, আমি আমার জাতিরক্ষার জন্য সংগ্রাম করিব,কারণ জাতীয়তাই মানবতা ও বিশ্বমানবতার লক্ষ্যে উপস্থিত হইবার অবশ্যম্ভাবী পথ”।
 
আমরা যদি সাভারকরের ‘হিন্দুত্ব ‘গ্রন্থটির প্রতি মননিবেশ করি, তাহলে দেখবো তিনি এখানে বলেছেন,
             আসিধু -সিন্ধু পযন্তা যস্য ভারতভূমিকা।
             পিতৃভঃ পুণ্যভুশচৈব স বৈ হিন্দুরিতি স্মতূঃ।
 
১৯৩৮ সালের নাগপুর অধিবেশনে আবার তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন ‘হিন্দু’একটি  জাতিবাচক শব্দ, বৈদিক, বেদ-বিরোধী  Buddhist, jain, শিখ, পার্বত্য জনজাতি, অরণ্যবাসী সকল ভারতবাসীই’ হিন্দু’।তার নিজের ভাষায়, “……consolidate and strengthen Hindu nationality ;not to give wanton offence to any of our non-Hindu compatriots, in fact to anyone in the world, but in just and urgent self defence of our race and land……” সাভারকরের স্পষ্ট বক্তব্য :”হিন্দু জাতীয়তাবাদকে সংহত ও শক্তিশালী করতে হবে ;অবশ্য এইজন্য অহিন্দু অধিবাসীদের ওপর প্রকৃতপক্ষে বিশ্বের কোনো ব্যক্তির ওপর কোনো অন্যায় আক্রমণ করা হবেনা। কিন্তু আমাদের জাতি ও দেশের ন্যায়সঙ্গত ও জরুরি আত্মরক্ষার প্রয়োজনে এবং যারা সমগ্র বিশ্বে নিজেদের ‘pan -ism’ রক্ষার জন্য সংগ্রাম করছেন তাদের বিশ্বাসঘাতকতা ও বিনা প্ররোচনামূলক আক্রমণের বিরুদ্ধে আমরা প্রত্যাঘাত করব। সাভারকর কংগ্রেসের তোষণ বা সমঝোতার নীতিতে বিশ্বাস করতেন না।তিনি সুস্পষ্টভাবে মুসলিমদের বলেছিলেন :” If you come, with you;If you don’t, without you;and if you oppose, inspite of you, the Hindu’s will continue to fught for their national freedom as best as they can.”এর সারকথা হল -যদি তোমরা আমাদের সাথে থাকো, তাহলে তোমাদের সাথে, যদি সাথে না থাকো, তোমাদের ছাড়াই এবং যদি বিরোধিতা কর,তা সত্ত্বেও হিন্দুরা তাদের সাধ্যমতো জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।তিনি ভারতের আশু ও পূর্ণস্বাধীনতা অর্জনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন, এ যেন তিলকের ধ্বনির প্রতিফলন -‘স্বরাজ আমার জন্মগত অধিকার’।তার বিশ্বাস ছিল…. The times of the univers -there the forntiers of my country lie.”
 
ইতোমধ্যে সাভারকরের প্রচেষ্টায় হিন্দু মহাসভা পুনরায় সামাজিক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এইসময় হিন্দু মহাসভার সবচেয়ে বড় আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল নিজাম শাসিত হায়দ্রাবাদে।এখানে হিন্দুদের উপর অত্যাচার দিনে দিনে বেড়ে চলেছিল। আর.এস.এস এখানে হিন্দুদের রক্ষার জন্য তীব্র লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল, সামাজিকভাবে। যেহেতু আর.এস.এস রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ছিলনা, তাইজন্য তারপক্ষে আন্দোলন সংগঠিত করা সম্ভব হয়নি। আসরে নামে হিন্দু মহাসভা। সাভারকরের আহ্বানে এবং লক্ষ্মণ রাও বলবন্ত ভোপতকারের পরিচালনায় হিন্দু তরুণগণ নিজামের বিরুদ্ধাচরণ করে আন্দোলন সংঘটিত করে। সাভারকর হায়দ্রাবাদে ভাষণ দেন তথাকথিত জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতাদের উদ্দেশ্য করে,”আপনারা কি অবগত নহেন যে,নিজাম রাজ্যে হিন্দুগণ সভাসমিতি করিতে,ধার্মিক বা সামাজিক শোভাযাত্রা করিতে,এমন কি পুরাতন মন্দির ও নূতন বিদ্যালয় স্থাপন করিতে এবং তাহেদের সন্তান -সন্ততিদিগকে মাতৃভাষায় শিক্ষা দিবার অধিকার হইতে বঞ্চিত”! ১১ মাস অবিশ্রান্ত সত্যাগ্রহে ১৫,০০০ হিন্দু কারা বরণ করেছিল। কংগ্রেসের উদাসীনতা সত্ত্বেও সাভারকর সংগ্রামে জয়ী হন; নিজাম সরকার হিন্দুদের রাষ্ট্রীয় সম্মান এবং অধিকার স্বীকার করতে বাধ্য হয়।
 
এরপর ১৯৩৯এ কলকাতা ;১৯৪০ -এ মাদুরাই;১৯৪১ -এ ভাগলপুর ;১৯৪২-এ কানপুর ;এবং ১৯৪৩ -এ অমৃতসর সন্মেলনে পরপর সাতবার হিন্দু মহাসভার সভাপতি নির্বাচিত হন সাভারকর।
 
১৯৩৯ সালে খুলনা জেলার গান্ধীপার্ক অঞ্চলে প্রাদেশিক মহাসভার অধিবেশনে সাভারকর ‘বন্দেমাতরম’ধ্বনির মাধ্যমে যুবকদের দেশের জন্য অনুপ্রাণিত করেন। ১৯৩৯ সালে ডিসেম্বর মাসে কলিকাতায় অখিল ভারত হিন্দু মহাসভার অধিবেশন আহুত হয় এবং তাহাতে সভাপতিত্ব করেন সাভারকর। সাভারকর তখন যুবমহলে সবচেয়ে পরিচিত নাম। তিনি কতটা জনপ্রিয় তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৪০ সালে মার্চ মাসে কলিকাতা পুরসভা নির্বাচনে। হিন্দু মহাসভা পেয়েছিল ২০,২১৩ ভোট, এবং তার প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়েছিল ২১,৪৪২। ভুলে গেলে চলবেনা এই দলটি ছিল সুভাষচন্দ্র বসুর।Bengal Assembly   র উপনির্বাচনে মহাসভা পায় ১১,১৫১ ভোট  এবং তাহার প্রতিদ্বন্দ্বী পায় ২,৩২৭ ভোট। কংগ্রেস এইসময় থেকে হিন্দুমহাসভাকে সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল বলে উপহাস এবং উপেক্ষা করতে শুরু করে। 
                           মুসলিম লীগ ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে মুসলিমদের জন্য আলাদা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রগঠনের দাবি জানায়।এই প্রসঙ্গতে সাভারকর বললেন, হিন্দুজাতির কাছে পাকিস্তানরূপী পরগাছা নতুন নয়। ভারতের পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে মাঝে মধ্যে এইধরনের পরগাছার উদ্ভব হতে দেখা গেছে বারবার।