#গল্পেইতিহাস
কলমে শ্রীজা গুপ্ত
 
আচ্ছা যদি প্রশ্ন করি মাহেলা জয়বর্ধনের সাথে হুগলীর জয়দেব মালাকারের বা জ্যাকলিন ফার্নান্ডেজের সাথে ঝুমকি বিশ্বাসের মিল কোথায় কি উত্তর হবে? 
 
– খুব সোজা উত্তর হবে এরা হয়ত ওদের খুব বড় ফ্যান৷
 
ইতিহাস কিন্তু আরেকটা ব্যাঁকা উত্তর দেয়৷ বিষয়টাই ব্যাঁকাপারা যে! সে বলে ওদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে৷ মানে মানছি এরা কেউ কাউকে চেনেনা,জানেনা কিন্তু হতেই পারে যে জয়বর্ধনের ভীষণরকম আদি কোনও জ্যাঠামশাই হয়ত জয়দেবের অতি ভীষণরকম আদি পিসেমশাই ছিল৷
 
– দুপুরে আজ কি দিয়ে ভাত খাওয়া হয়েছে?
 
সব প্রশ্নগুলো একটু চেপে রেখে এই বর্ষার ওয়েদারে শোনাই যাক নাকি একটা রূপকথা?
 
– ব্যস গল্পের গরু এবার যাত্রা শুরু করলো!
 
তো সেই গরুর গাড়িতে করেই আমরা চলে যাই যীশুর জন্মের মোটামুটি পাঁচশো বছর আগে আমাদের হুগলি জেলার এক নদীর তীরে৷ না “আমাদের ছোট নদী” ছিলনা সে, রীতিমত বড় নদী ছিল নাম সিংহরণ৷ সেই নদীর ধারে ছিল এক বিশাল নগর তার নাম “সিংহপুর” (প্রাচীন নাম লাউরট্ট) আর এই সিংহপুরের শাসক ছিলেন রাজা সিংহবাহু৷ তার হাতিশালে কত হাতি, ঘোড়াশালে কত ঘোড়া ছিল জানা না গেলেও তিনি বেশ পরাক্রমশালী ছিলেন তা জানা যায়৷ 
 
– লাউরট্ট কিভাবে সিংহপুর হয়ে যায়? কোনও মিল নেই!
 
যেভাবে টালিগঞ্জ মেট্রোস্টেশন ‘মহানায়ক উত্তরকুমার’ হয়ে যায় সম্ভবত ওইভাবে৷ মানে রাজা সিংহবাহুর নামেই হয়ত জায়গার নাম পরিবর্তন হয়৷ তো এই সিংহপুরের… আচ্ছা এতবড় নামটা বারবার না লিখে বরং ছোট করে দিই “সিঙ্গুর”৷ হ্যাঁ তো এই সিঙ্গুরের রাজপুত্র..
 
– ওয়েট ওয়েট সিঙ্গুর? হুগলির সিঙ্গুর? মানে আমাদের এই সিঙ্গুরের কথা হচ্ছে নাকি?
 
– আজ্ঞে হ্যাঁ৷ আমাদের আপনা সিঙ্গুর৷  এবার বলি বাকিটা?
 
সিংহপুরের রাজপুত্র বিজয়সিংহ৷ নাম তার যতটা কঠিন স্বভাব ততটাই তরল, অত্যন্তঃ বাজে কিছু বন্ধুসঙ্গে সে গোল্লায় গিয়েছিল ছোট থেকেই৷ বয়স তার যত বাড়তে লাগলো রঙীন স্বভাব আরও প্রকাশ পেতে থাকলো৷ তো বারবার বারণ সত্ত্বেও যখন সে নিজেকে শোধরালোনা তখন তার পিতা সিংহবাহু প্রমাদ গুনলেন! রাজ্যের সমস্ত জ্ঞানবৃদ্ধদের ডেকে একটি সভা বসালেন ও তাদের পরামর্শে বিজয়কে ঘাড় ধরে প্রথমে তাম্রলিপ্ত নিয়ে গেলেন তারপর অর্ধমস্তক মুন্ডন করে জাহাজে চাপিয়ে দিয়ে বললেন ‘যাও বাছা বাপের টাকায় ফূর্তি না মেরে নিজে উপার্জন করে দিনরাত আনন্দ করো কেউ বারণ করবেনা৷ আর সাথে এই ল্যাঙবোটগুলোকেও নিয়ে যাও, দেখব এবার তারা কত সঙ্গ দেয় তোমায়..” বলে বিজয়ের বাকি বন্ধুবান্ধবদেরও সেই জাহাজে তুলে দেন ( কথাগুলো আমার কল্পনা, তবে অনুমেয় নয় কি?) তবে সিংহবাহু এতটাও কঠোরহৃদয় ছিলেন না, যতই হোক তিনি বাবা তো! তাই সাথে বেশ কিছু সৈন্যসামন্ত, চাকর বাকর, অমাত্য আর পর্যাপ্ত খাবারও দিয়ে দেন ওই জাহাজে৷ কিছু বইতে আছে জাহাজ মোট সাতটি ছিল এবং মানুষ ছিল ৬৯৯ জন! (Source: দীপবংশ)
যাই হোক সেই সব জাহাজ যেদিন লঙ্কাদ্বীপের তাম্বপাণিতে এসে পৌঁছায় ঠিক সেদিনই ভারতের কুশিনগরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন ৮০ বছরের এক বৃদ্ধ, গৌতম বুদ্ধ (আনুমানিক ৫৪৪ খ্রীঃ পূঃ)৷ 
 
হ্যাঁ সেই রাবণরাজের লঙ্কাদ্বীপ৷ তাম্বপাণিতে নেমে বিজয়সিংহ দেখেন সেখানে যক্ষরা রাজত্ব করেন৷ কয়েকদিন সময় নেন তিনি ও তাঁর অনুচররা সে অঞ্চলকে বুঝতে৷ এরমধ্যে বিজয়সিংহের সাথে আলাপ হয় যক্ষকন্যা কুবেনির৷ ব্যস একটা রোম্যান্টিক গানের সিকোয়েন্স পেরনোর পর সেই মেয়েটির সাহায্যেই যক্ষরাজকে পরাজিত করে তার রাজধাণী দখল করে নেন বিজয়সিংহ৷ সেখানে স্থাপন করেন তাঁর নতুন রাজ্য, নিজের জন্মভূমি এবং পিতার স্মরণে লঙ্কাদ্বীপের নতুন নামকরণ করেন – “সিংহল”..
 
বয়স বাড়ার সাথে সাথে তিনি ক্রমশ এক দক্ষ শাসকরূপে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকেন স্থানীয় মানুষের মনে (স্থানীয়রা তাই নিজেদের ‘সিংহলী’ বলতে শুরু করেন)৷ সিংহলে বন্যা প্রতিরোধ করার জন্য তিনি কৃত্রিম বাঁধ ও জলাধার তৈরি করেন (Source : Irrigated India – Alfred Deakin)৷ 
পরবর্তীকালে দক্ষিণ ভারতের পান্ড্য রাজপরিবারের সাথে তাঁর বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়৷ তবে তিনি নিঃসন্তান ছিলেন তাই তিনি শেষ বয়সে ছোটভাই সুমিত্রকে  সিংহলের শাসনভার গ্রহণের জন্য ডেকে পাঠান৷ কিন্তু সিঙ্গুর থেকে শ্রীলঙ্কা তো আর মুখের কথা নয়! তাই ভাই আসার আগেই ৩৮ বছর দাপটে শাসন করার পর মৃত্যুবরণ করেন বাঙালি সম্রাট বিজয়সিংহ, যাকে মনে রাখার দায় রাখিনি আমরা একবারও! 
 
তাঁর মৃত্যুর পর সিংহলে আসেন ভাইপো বাসুদেব ( বয়সজনিত কারণে সুমিত্র আসেননি আর), সহজেই অনুমান করা যায় তিনি একা আসেননি, প্রচুর বাঙালি লোকজনও আসেন তাঁর সাথে৷ যাই হোক তিনিও প্রায় ৩০ বছর রাজত্ব করেন সেখানে৷ এখানেই শেষ নয়, মাঝে বারসাতেক আক্রমন হলেও সিংহলে এঁদেরই বংশধরেরা ১৮৯ টি জেনারেশন অর্থাৎ প্রায় ২০০০ বছর ধরে রাজা হতে থাকেন যতদিন না পর্তুগীজ ও ওলন্দাজরা সেখানে এসে পৌঁছায়!!
 
– তার মানে..
 
– হ্যাঁ তার মানে এটাই যে আজকের শ্রীলঙ্কার প্রায় ৭৫% মানুষ বঙ্গ ও তামিল রক্তের মিশ্রণে সিংহলী… আর ওই যে যক্ষরাজাকে হারিয়েছিল বিজয়সিংহ সেই আদিবাসীরা এখন হাজারে দু’জন মাত্র৷
 
– এত সিনেমাটিক গল্প কোথাও লেখা নেই কেন?
 
– কে বললো নেই? দীপবংশ, মহাবংশ, বলাহসস জাতক এগুলিতে পাওয়া যায় ডিটেইলসে৷ তাছাড়া সিঙ্গুরে বা তার কাছাকাছি যারা থাকেন তাদেরকে প্রশ্ন করলেই জানা যাবে দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়ের ধারে সিঙ্গুর ব্লকের উত্তরে “সিংহল পাটন” বলে কোনও গ্রাম আছে কিনা! ওখানেই রাজা সিংহবাহু তাঁর রাজপাটের ‘পত্তন’ করেন৷ একসময়ের “সিংহল পত্তন” এখন ‘সিংহল পাটন’ যা আগে নদীবেষ্টিত এলাকা ছিল৷ এখান থেকেই সিংহবাহু সরস্বতী নদীপথে বাণিজ্য করতেন, হয়ত নির্বাসনেও দিতে নিয়ে গিয়েছিলেন ছেলে বিজয়সিংহকে এই নদীপথ দিয়ে তাম্রলিপ্তে ( ভাগ্যিস শাস্তিটা দিয়েছিলেন, নাহলে ইতিহাস উল্টেপাল্টে দেওয়া  এরকম ঘটনা তো ঘটতো না!) যাই হোক এখনও মজাখাল রূপে সরস্বতী বিরাজমান সিঙ্গুরে!
 
অজন্তা বেড়াতে গেলে সেখানে ‘বিজয়সিংহের রাজ্যাভিষেক’ এর চিত্র অঙ্কিত আছে সযত্নে দেখতে পাবেন সবাই৷ আমাদের হুগলি জেলার এক বাঙালি ছেলের ছবি জ্বলজ্বল করছে অজন্তার গুহাচিত্রে ভাবলে চোখ ভিজে ওঠে বইকি!
 
অনেক ঐতিহাসিক নাকি বিজয়সিংহকে দক্ষিণ ভারতীয় বা গুজরাটের শাসক প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাদের দুর্ভাগ্য যে সিংহলরাজ নিঃশঙ্কমল্লের শিলালিপি পাওয়া গেছে যেখানে স্পষ্টভাবেই লেখা যে বিজয়সিংহ বাংলা থেকে এসছিলেন৷ ( ভেবেছি কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে এটা দশবার বলাবো)
 
কি একটা অজানা কারণে বাংলা ও তার অতীতকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয় বারংবার৷ আগেও বলছি, এখনও বলবো তার দায় ৯০% আমাদের৷ আমরা কোনও পাঠ্যবইতে পড়েছি বিজয়সিংহের কথা? শ্রীলংকার সাথে বাংলার এই গভীর যোগাযোগের কথা? অথচ সিংহলবাসীদের চিরাচরিত বিশ্বাস তারা বাঙালি৷ না এটা আমি বলিনি, বলেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিংহলী ভাষার অধ্যাপক শীলানন্দ আরেক বিদগ্ধ পন্ডিত দীনেশচন্দ্র সেন কে৷ আমরা রামচন্দ্রের লঙ্কাবিজয়ের গল্প জানি, তাকে সত্যি বলেও বিশ্বাস করি৷ হয়ত সত্যি বা হয়ত নয় ( আমি যা দেখতে পাইনা তাকে ‘নেই’ বলতে পছন্দ করিনা৷ ওপেন রাখি সব সম্ভাবনা) কিন্তু শিলালিপি থেকে গুহাচিত্র, ধর্মগ্রন্থ থেকে স্কলারদের গবেষণাধর্মী লেখা সবেতেই যে লোকটার কথা আছে তাকেই জানিনা?! 
শিকড় ছাড়া বড় হওয়া যায়না, বিজ্ঞানসম্মতই নয় সেটা৷ তাই অজন্তা ঘুরতে গেলে বিজয়সিংহের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আমি বলবো “ক্ষমা করো৷” 
আপনারা? 🙂
 
©শ্রীজা গুপ্ত
 
ছবি : অজন্তার গুহাচিত্র
 
তথ্যসূত্র : (i) পৃথিবীর ইতিহাস (৪র্থ খন্ড) – দুর্গাদাস লাহিড়ী
(ii) হুগলি জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ – সুধীর কুমার মিত্র
(iii) The Geographical Dictionary of ancient & medieval India by Nandalal De
(iv) Wikipedia
(v) Dailyhunt
(vi) ফেসবুক পেজ – https://www.facebook.com/tdasgupto/